বাড়ি আসলে কী? এ এক জটিল প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শিল্পী রাহুল আনন্দের মুখোমুখি হয়েছিলাম গত বছর। উত্তরও পেয়েছিলাম। ১৪০ বছরের পুরোনো একটি ‘ভাঙা বাড়ি’তে তিনি থাকতেন। এই বাড়িতেই আতিথ্য নিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। তবে স্বপ্নের বাড়িটিই এখন আর নেই। গত সোমবার, ৫ আগস্ট তাঁর বাড়িতে থাকা সহস্রাধিক যন্ত্র ভাঙচুর থেকে শুরু করে পুড়িয়ে ফেলা হয় সবকিছু। বাদ্যযন্ত্র, গানের নথিপত্র, অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও আসবাবসহ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! শিল্পী কি কোনো দিন ভেবেছিলেন, এক কাপড়ে বের হয়ে যেতে হবে স্ত্রী আর ১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে?
সম্প্রতি অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে হামলার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে জলের গান। সেখানে লেখা হয়েছে , ‘জলের গানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসতবাড়ি ছিল না; ছিল পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সুর, আর দাদার ভাবনাপ্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তা-ই নয়।
‘জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীতচর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক-রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।’
ব্যান্ডটি আরও লিখেছে, ‘যাঁরা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তাঁরা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও ঊর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সব সময় খোলাই থাকত। তাতে তালা দেওয়া হতো না, যাতে যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছাতে পারেন। আর যাঁরাই দিনের যেকোনো প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হলো, রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তাঁর নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন। জলের গানের বাদ্যযন্ত্র। রাহুল আনন্দের বিরাট ভাবনা ও স্বপ্নের দিকে ধাবমান এক নিরন্তর প্রয়াস। আমাদের দেশীয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র।’
বাড়ি, বাড়িতে থাকা মানুষ আর পোষ্যরা ছাড়াও ছোটবেলা থেকে তিল তিল করে তৈরি করা বাদ্যযন্ত্রের প্রতি রাহুল আনন্দের যে ভালোবাসা আর আবেগ, সেটা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। আমার সেই সুযোগ হয়েছে। তাই গত বছরের লেখাটা হুবহু তুলে ধরলাম পাঠক আপনাদের জন্য। যাতে আরও একবার বাড়িটি নিয়ে তাঁর ভাবনার তল পেতে পারেন।
বাড়ির উঠানে পা রাখতেই বেশ আরাম বোধ হয়। বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাটির সোঁদা গন্ধ এসে নাকে লাগতেই চারপাশটা একটু দেখে নিই। পুরোনো বাড়ির গা ঘেঁষে নানান গাছপালা ঘিরে আছে, সেখানে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। লম্বা বারান্দায় ঝুলছে সলতে দেওয়া কুপিবাতি, হারিকেন, পুরোনো চিঠির বাক্স, গাছ, কিংবা নানা চিত্রকর্ম। একতলা বাড়ির বারান্দার আরেক কোণে সাজানো পিতল আর কাঠের তৈরি নানা শৈল্পিক সামগ্রী। ঝুলছে দোতারাও। একটা ভিনটেজ আমেজ আছে বাড়িটায়। ভিনটেজই বটে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়ির বয়স এখন ১৪০ বছর। আর এখানেই থাকেন শিল্পী দম্পতি রাহুল আনন্দ ও ঊর্মিলা শুক্লা।
রাহুল আনন্দ বললেন, তিনি আদর করে এই বাড়ির নাম দিয়েছেন ‘ভাঙা বাড়ি’। কিন্তু তাঁর এই ভাঙা বাড়িতেই গত আট বছর ধরে আছেন সবাই। রাহুল-শুক্লা দম্পতি ও তাঁদের একমাত্র ছেলে তোতা ছাড়াও এই বাড়িতে আরও অনেকের বাস। পোষা কুকুর ও বিড়ালের সঙ্গে প্রতিবেশী পোষ্যরাও এখানে সসম্মান থেকে যায়। একটা মায়া আছে বাড়িটায়।
বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল একতলা হলেও বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে তৈরি হয়েছে এই বাড়ি। অনেকগুলো ঘর। একেকটার আমেজ একেক রকম। শহরের বিশাল বিশাল অট্টালিকার চাকচিক্যের সঙ্গে এই বাড়ির তুলনা করলে কিছুটা ভুল হবে। আসলে মিলবেও না। বরং শহরের প্রাণকেন্দ্রে থেকেও ভিড়ভাট্টা আর কোলাহলও এখানে নখ বসাতে পারে না।
পুরোনো হলেও শিল্পী দম্পতি এই ভাঙা বাড়িকে প্রাণ দিয়েছেন বেশ যত্ন করে। রাহুল আনন্দ জানালেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই পুরোনো মানুষ, পুরোনো বাড়ি, পুরোনো বৃক্ষ, পুরোনো সংস্কৃতিকে খুব ভালোবাসি। পুরোনো সবকিছুই আমাদের টানে। সেই ভেবে পুরোনো বাড়ির সন্ধান করতে করতেই এই বাড়িটা পেয়ে যাওয়া।’
সত্যিকার অর্থে বাড়িটা এক সময় ভাঙা বাড়িই ছিল। থাকার অযোগ্য বা পরিত্যক্ত যাকে বলে। মালিকের কাছে যখন বাড়িটা ভাড়া চাওয়া হয় তখন তিনি বলেছিলেন , ‘এখানে তো থাকতে পারবেন না। ইঁদুর-বেজি সবই থাকে।’ তবু রাহুল আনন্দ রাজি হয়ে জানিয়েছিলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই, আমি ওদের সঙ্গেই থাকব আর বাসযোগ্য করে নিয়েই থাকব।’
আসলে পরিত্যক্ত বলে তিনি কাউকে এই বাড়ি ভাড়াও দিচ্ছিলেন না। কিন্তু মালিকের এটাও বিশ্বাস হয়েছিল, ‘শিল্পী মানুষ, হয়তো বাড়িটায় প্রাণ ফিরবে, সুন্দর কিছু হবে।’ আসলে হয়েছেও তা-ই। একটা বসবাস-অযোগ্য বাড়িকে সেবা-শুশ্রূষা আর পরম ভালোবাসা দিয়ে থাকার উপযোগী করে তুলেছেন তাঁরা। দেড় মাসের মতো সময় লাগে সব ময়লা-জঞ্জাল পরিষ্কার করে বাড়িটায় উঠতে।
এই বাড়িতে এখন কুকুর-বিড়াল ছাড়া অনেক কবুতর আর ১১টা বেজিও আছে, জানালেন রাহুল আনন্দ। বেজির কথা শুনে প্রশ্ন করে বসি, এগুলো কি পোষ্য?
শিল্পীর সাবলীল উত্তর, ‘আমি কোনো কিছু বেঁধে রেখে পালি না; ছেড়ে পালতেই ভালোবাসি।’ একটা পিঁপড়ার লাইন চোখে পড়লেও সেটা তিনি ভাঙেন না। রাহুল আনন্দর প্রকৃতিপ্রেম বেশ গভীর, বোঝাই যায়।
কথা প্রসঙ্গে জানালেন ১৪০ বছর পুরোনো এই বাড়ির ইতিহাসও। বাড়ির বর্তমান মালিকের বাবা এই জমি কিনেছিলেন জমিদার দ্বারিকানাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। সেই সময় তিনি আর তাঁর স্ত্রী এখানেই থাকতেন।
বাড়ির ইতিহাস শুনতে শুনতে রাহুল আনন্দের অন্দরমহলের সবচেয়ে সুন্দর রুমটায় ঢুকি। তাঁর গানের ব্যান্ড ‘জলের গান’-এর পোস্টার আঁকা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে হারিয়ে যাই বাদ্যযন্ত্রের ভুবনে। নানা ধরনের শতাধিক বাদ্যযন্ত্র ঘরের দেয়ালে ঝুলছে বা রাখা আছে।
যাঁরা রাহুল আনন্দের ভক্ত, তাঁরা অবশ্য জানেন, তিনি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে বাজাতে ভালোবাসেন। তাই বাড়ির এই ঘরটা গানবাজনা করার জন্যই বরাদ্দ। ঘুম থেকে উঠে নাশতা করার আগেই ঘরে ঢুকে সংগীতচর্চার জন্য নানা যন্ত্র বানাতে বসে যান তিনি। আর ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত চলতেই থাকে যন্ত্র তৈরির নানা নিরীক্ষা। পাশের ঘরেও রাখা আছে আরও অভিনব সব বাদ্যযন্ত্র। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা পাঁচ শর বেশিই হবে, জানালেন শিল্পী।
সাইকেল চালাতে বেশ ভালোবাসেন রাহুল আনন্দ। সে বয়স আর তাঁর নেই বলে মনে করেন তিনি। তবে এখন আর বিশ্বভ্রমণের বয়স নেই বলে সাইকেলকে অন্য উপায়ে কিন্তু বিশ্ব বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। কীভাবে?
সাইকেলের নানা অংশ দিয়ে রাহুল আনন্দ তৈরি করেছেন বাদ্যযন্ত্র। একেকটা বাজে একেক সুরে। কোনোটা থেকে বের হয় টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ, কোনোটায় সমুদ্রের গর্জন আবার কোনোটায় সুরেলা বাঁশির মতো শব্দ। তবে একটা থেকে আরেকটার শব্দ বেশ আলাদা। তাঁর ইচ্ছা, পরবর্তী প্রজন্ম যেন এগুলো এগিয়ে নিয়ে যায়।
রাহুল আনন্দের এই ভাঙা বাড়ি নিয়ে সম্প্রতি হইচই পড়ে গেছে। সবার আলোচনায় এখন এই বাড়ি। কারণ, কয় দিন আগে এখানে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের তত্ত্বাবধানে রাহুল আনন্দের স্টুডিও পরিদর্শন করার ইচ্ছা থেকেই চলে আসেন শিল্পীর বাড়িতে। ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ছিলেন তিনি এই ১৪০ বছরের পুরোনো বাড়িতে। এই সময় রাহুল আনন্দের একতারা বাজিয়ে গান গাওয়া, লাল চা খাওয়া আর একতারা শেখা—সবই ফরাসি প্রেসিডেন্ট বেশ উপভোগ করেছেন। কারণ, তিনি নিজেও একজন সংগীতশিল্পী।
বিদায় নেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট রাহুল আনন্দের কাছে তিনবার জানতে চেয়েছেন, তিনি তাঁর কাছে কিছু চান কি না। কিন্তু রাহুল তিনবারই এমন স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন, যা কিনা অন্য কেউ নয়, নিজেকেই পূরণ করতে হবে। তা হলো, ‘গাছ লাগানো, বাদ্যযন্ত্র তৈরির মাধ্যমে সাইকেল নিয়ে ভ্রমণ করা আর আধ্যাত্মিকতায় বাঁচা।’
কথা বলতে বলতে রাহুল আনন্দের কাছে জানতে চাই তাঁর শৈশবের বাড়ির গল্প। বললেন, সিলেটের আদি জমিদার বাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। যদিও এখন সেটা বসবাসের অযোগ্য। বটগাছ উঠেছে; খসে পড়েছে বাড়ির দেয়াল; রয়েছে নানা মিথও সেই বাড়িকে ঘিরে। ওই বাড়িতেই রাহুল আনন্দ স্বাচ্ছন্দ্যে রাজার মতো বেড়ে উঠেছেন। তারপর জীবনের তাগিদে, মানুষকে জানার আনন্দে থেকেছেন অসংখ্য বাড়িতে।
বাড়ি বলতে রাহুল আনন্দ কী বোঝেন?
প্রশ্নটা শুনে ভাবতে হয়নি তাঁর। বরং এককথায় উত্তর, ‘এটা একটা আশ্রয় আর প্রশ্রয়। লিফটের বোতাম টিপে যে বাড়িতে ওঠা যায় সেটাও বাড়ি; আবার মশারি টাঙিয়ে ফুটপাতে শুয়ে চাঁদ-তারা দেখা মানুষের ওটাও বাড়ি। আমার এই ভাঙা বাড়িও বাড়ি। সেখানে সাশ্রয়ে থাকা যায় বেশ আনন্দে। ঢাকা শহরের ফুটপাত, চারুকলার বারান্দা, রেলস্টেশন—সবখানেই থাকার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কারণ, আমি মানুষের গোড়ায় ঢুকে মিশতে ভালোবাসি। মুগ্ধ হয়ে আমি মানুষ দেখি। কথাগুলো বলতে বলতেই রাহুল আনন্দ জলের গানের তাঁর লেখা ‘ঢাকানামা’ গানটি গাইতে আরম্ভ করেন।
অচেনা রাস্তায়, তিন চাকা রিকশায়
বিপরীতমুখী চেনা মুখ
ইট-কাঠ-পাথরে-উঁকি মারে অন্দরে
‘ভালোবাসা’ নামের অসুখ।
এখানেই শেষ নয়। তাঁর ভাঙা বাড়ির আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে নানা শিল্পকর্ম। রাহুল আনন্দ ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই চারুকলার ছাত্র ছিলেন। একমাত্র ছেলে তোতাও বাবা-মায়ের মতোই শিল্পমনা। পাপেট বানাতে, ছবি আঁকতে আর বাবার মতন মিউজিক করতে ভালোবাসে সে। জঞ্জালে ভরা ইট-কাঠ-পাথরের নগরীতেও যে নিরিবিলি সুখের নীড় গড়ে তোলা যায়, এর প্রমাণ সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দ নিজেই। নামের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েই জীবনকে উপভোগ করেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী। তাঁর কাছে বাড়ি মানে আসলেই আশ্রয় আর প্রশ্রয়, যেখানে নির্দ্বিধায় সবাইকে নিয়ে থাকা যায়। সে হোক মানুষ, গাছ কিংবা প্রাণী।
ছবি: অনিক মজুমদার