চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশ অঞ্চলের পেয়ারা শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। এই পেয়ারাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে লোকশ্রুতি, আঞ্চলিক গান, পারিবারিক ঐতিহ্য আর হাজারো মানুষের জীবিকার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে এই ফলের সুনাম। গ্রামবাংলার হাটে হাটে এখনো এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে লাল কাপড়ে বাঁধা ঝুড়িতে।
পটিয়ার পেয়ারা, পতেঙ্গার তরমুজ, লাইল্যার হাটের বাকরখানি—এসব নিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে উঠে এসেছে এক বিশেষ ঘ্রাণ, এক স্বাদময় আত্মপরিচয়। সঞ্জিত আচার্য ও শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় গান ‘গয়াম ভাল পটিয়ার, তরমুজ ভাল পতেঙ্গার’ যেন পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা নিয়ে গর্বেরই প্রকাশ। স্থানীয় লোকজন পেয়ারাকে বলেন ‘গয়াম’ বা ‘গোয়াছি’।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৮৫০ সালের দিকে কচুয়াই চা–বাগানের ব্রিটিশ মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে পেয়ারা ও লিচুবীজ এনে রোপণ করেন। সেখান থেকেই হয়েছে পেয়ারাবাগানের বিস্তার। আজ পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা দেশের অন্যতম বিখ্যাত ও রপ্তানিযোগ্য ফল।
এই এলাকার পেয়ারা স্বাদে মিষ্টি, বিচি কম, ভেতরে রং সাদা, হলুদ কিংবা লালচে। চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকার প্রবীণ বাগানমালিক আইয়ুব আলী খানের বাবা ১৯৬০ সালে ১০ একর জমিতে পেয়ারাবাগান শুরু করেন। বর্তমানে তাঁদের পরিবারের বাগান ৪০ একরে পৌঁছেছে।
পটিয়ার হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগর, হাসিমপুর, জামিজুরী এলাকায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ পেয়ারা চাষের সঙ্গে যুক্ত। পেয়ারাই তাঁদের মূল আয়ের উৎস।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারা হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ ভার (এক ভার মানে ২০ কেজি) পেয়ারা বিক্রি হয় এখানে। এখানকার পেয়ারা চট্টগ্রাম নগর, কক্সবাজার, চকরিয়া, হাটহাজারী, লোহাগাড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়।
শুধু দেশেই নয়, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা রপ্তানি হয়ে থাকে।
শিকড়ের সঙ্গে জড়ানো এই ফল আজ শুধু কৃষিপণ্য নয়, আঞ্চলিক সংস্কৃতিরও গর্বিত প্রতিনিধি। এই ফল পেতে পারে ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ। তাহলে এর বাজার বিস্তৃতির সঙ্গে অঞ্চলিক পরিচয় আরও বেশি করে গুরুত্ব পাবে।
ছবি: লেখক