আপনি একবার ভেবে দেখুন তো, আপনার জীবনে চলার পথে এমন কোনো মুহূর্ত কি আছে, যেখানে কারও একটিমাত্র কটু কথা আজও আপনাকে কষ্ট দেয়? হয়তো সেটা বলেছিল কোনো সহপাঠী, সহকর্মী, কিংবা খুব কাছের কেউ। তখন সেই কথা শুনে আপনার বুকের ভেতর যেন কিছু ভেঙে পড়েছিল। আজও যখন ঘটনাটি মনে পড়ে, শরীরের ভেতর একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে যায়, যেন আপনি সেই মুহূর্তে আবার ফিরে গেছেন। অন্যদিকে গত মাসে বা গত সপ্তাহে হয়তো আপনি কারও অনেক সুন্দর প্রশংসা পেয়েছেন। কেউ আপনার কাজের তারিফ করেছে, কেউ বলেছে আপনাকে দারুণ লাগছে, কেউ আপনার প্রতিভার প্রশংসা করেছে। আপনার সেই মুহূর্তে কথাগুলো ভালো লাগলেও, আজ তার অর্ধেকই আপনার মনে নেই। যেন প্রশংসার স্মৃতি খুব দ্রুত ধুলো জমে ফিকে হয়ে যায়।
কিন্তু কারো করা কোনো অপমান যেন আপনার মনের দেওয়ালে খোদাই হয়ে থাকে। যত বছরই পেরিয়ে যাক না কেন, তার রং ফিকে হয় না। কেন এমন হয়? এর কারণ শুধু আবেগের খেলা নয়. এর গভীরে রয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের এক কৌশল, যা আমাদের আচরণ ও অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
মনোবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা নেতিবাচক মন্তব্য আমাদের মনে প্রশংসার চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, অপমানের মুহূর্তে আমাদের মস্তিষ্কে 'থ্রেট ডিটেকশন সিস্টেম' বা হুমকি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেউ আমাদের কটু কথা বললে মুহূর্তের মধ্যে সেটি সক্রিয় হয়। এটি মস্তিষ্কের সেই অংশ যা ভয় এবং বেঁচে থাকার সংকেতকে প্রক্রিয়াজাত করে। ফলে অপমানজনক মন্তব্যটি অনেক বেশি তীব্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কে জমা হয়, যা বছরের পর বছর, কখনও কখনও সারা জীবন আমাদের মনে গেঁথে যেতে পারে।
আমরা প্রশংসা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই কেন
আমাদের প্রশংসা পেতে ভালো লাগে, কারণ তখন আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামে এক হ্যাপি হরমোন বের হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো যে,প্রশংসার মধ্যে কোনো হুমকি নেই, তাই মস্তিষ্ক সেটিকে 'জীবন-মরণ'ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হিসেবে বিবেচনা করে দেখে না। ফলে বেশিরভাগ প্রশংসাই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের স্মৃতি থেকে মিলিয়ে যায়, যদি না সেটা অনেকবার শোনা হয় বা বিশেষ কোনো আবেগময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে।
শুধু মনের খামখেয়ালিপনা নয়, এ এক বৈজ্ঞানিক সত্য
বিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে বলে থাকেন, 'নেগেটিভিটি বায়াস' অর্থাৎ নেতিবাচক ঘটনাকে ইতিবাচকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় এটা ছিল বেঁচে থাকার একটি কৌশল যার উদ্দেশ্য ছিল বিপদের স্মৃতি মনে রেখে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকা। কিন্তু আজকের জীবনে এর ফলে আমরা সমালোচনাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিই, অথচ প্রশংসা আামাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। এর প্রভাব পড়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস, সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।
কীভাবে বদলাবেন এই প্রবণতা
১. আপনি প্রশংসা পাওয়ার পর সেটি লিখে রাখুন বা কাউকে শেয়ার করুন।
২. দিনের শেষে অন্তত ৩টি ভালো ঘটনা মনে করে ঘুমাতে যান।
৩. সমালোচনা বা অপমানকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে না দেখে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুন।
আমরা হয়তো অতীতের সেই অপমান মুছে ফেলতে পারব না, কিন্তু শিখতে পারি কীভাবে প্রশংসা ও ইতিবাচক মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখা যায়। জীবনের প্রতিদিনই আমাদের সাথে ছোট-বড় ভালো ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেগুলো মনে রাখতে হলে আমাদের সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে। প্রতিটি প্রশংসাকে শুধু কানে নয়, মনে গ্রহণ করতে হবে, যেন মস্তিষ্ক সেটি বুঝতে পারে ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে। কারণ শেষ পর্যন্ত, জীবন কেবল অপমানের স্মৃতি দিয়ে নয়, বরং সেই উষ্ণ, সুখময় মুহূর্তগুলোর আলোয় বেঁচে থাকার নাম।
তথ্যসুত্র: ফ্যাক্ট প্লাস
ছবি: হাল ফ্যাশন ও পেকজেলস