বাঁচার আর কোনো আশা নেই টাইটান অভিযাত্রীদের। মার্কিন কোস্টগার্ডের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে তা। শোকের সঙ্গে সঙ্গে কেন এই অকল্পনীয় পর্যায়ের ধনবান মানুষগুলো এভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিল, সে নিয়ে বিস্ময়ও কাজ করছে সবার মধ্যে। জোর আলোচনা চলছে আমেরিকান পর্যটন কোম্পানি ওশানগেটের এই মরণফাঁদস্বরূপ বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে। তাদের প্রবর্তিত ‘টাইটানিক ট্যুরিজম’ এখন বিশ্ববাসীর তোপের মুখে। তারপরও যুগে যুগে মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এই গভীর সমুদ্রে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার মতো চরম বিপৎসংকুল অ্যাডভেঞ্চারে যায়। তা–ও আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বা দুঃসাহসিক অভিযাত্রাভিত্তিক পর্যটন কোনো নতুন ধারণা নয়। একে আলট্রা-ভেঞ্চারও বলা হয়। ভয়, উৎকণ্ঠা আর বিপদে পড়লে যে অ্যাড্রিনালিন আলোড়ন ঘটে স্নায়ুতন্ত্রে, তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন অনেকে। এই প্রবণতাকে পুঁজি করে সারা বিশ্বেই বিভিন্ন কোম্পানি ও পর্যটন সংস্থা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে স্টকটন রাশ নামের এক অ্যারোস্পেস প্রকৌশলী ওশানগেট কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন আর সমুদ্রতলে ধ্বংস হওয়া এই টাইটান সাবমার্জ তিনিই চালাচ্ছিলেন।
তবে ২০২১ ও ২০২২ সালেও টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার এই ট্যুর আয়োজন করেছিল পর্যটন কোম্পানি ও গবেষণা সংস্থা ওশানগেট। এবারের সাবমার্জ ভেসেল টাইটানে পাঁচটিই আসন ছিল আর তা তৈরি হয়েছিল কার্বন ফাইবার আর টাইটানিয়াম দিয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফুট গভীরে নেমে গিয়ে টাইটানিক দেখার এই আট দিনব্যাপী ট্যুরের জন্য প্রত্যেক অভিযাত্রী খরচ করেছেন প্রায় আড়াই কোটির বেশি বাংলাদেশি টাকা। আর এই চরমধর্মী পর্যটন বা এক্সট্রিম ট্যুরিজম ব্যাপারটি আসলে বলতে গেলে পুরোটাই ‘থ্রিল’ খোঁজার সঙ্গে সম্পর্কিত।
জীবনে যাঁদের আর সেভাবে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, এমন অকল্পনীয় ধরনের ধনী ব্যক্তিদের মানসিক জগৎ অনেকটাই আলাদা হয় সাধারণ মানুষের চেয়ে। তাঁদের একঘেয়ে দিনযাপন উদ্দীপনা জাগায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ আর বিপজ্জনক কিছু করতে, যা জীবনে উত্তেজনা নিয়ে আসে। মাদকাসক্তি বা অপরাধপ্রবণতা ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার ও চরম কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একধরনের আত্মতৃপ্তির সন্ধান পান এই অতিধনাঢ্য ব্যক্তিরা। ড. লায়নস এভাবেই পুরো বিষয়টি এক নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন কাল। বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের কাউন্সেলিং ও থেরাপি দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁর কথা গুরুত্বসহকারেই বিবেচনা করছেন সবাই। তিনি এ–ও বলেন, নতুন নতুন সব প্রযুক্তি এই প্রায় অসম্ভব সব অভিযাত্রা সম্ভব করে দিচ্ছে তাঁদের জন্য, যাঁরা এর জন্য যত ইচ্ছা তত খরচ করতে চান।
এমনিতে অর্থনৈতিক অবস্থাই যেখানে সাধারণ জনগণের জন্য এক চ্যালেঞ্জ, সেখানে অর্থবিত্তের অভাব না থাকা মানুষগুলো জীবনকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেন এভাবে। তাঁরা মহাকাশে যেতে চান, সমুদ্রের গভীরে ডুব দেন, করেন স্কাই ডাইভিং বা বিপজ্জনক পর্বতারোহণ। এসব কাজ তাঁদের জীবনের অস্তিত্ব বোঝায়, জানায় যে তাঁরা বেঁচে আছেন। আরেক নির্ভরযোগ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে, এসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়ে পকেট ভারী করা কোম্পানিগুলো এই আলট্রা-ভেঞ্চার ট্যুরিজমের পক্ষে ক্যাম্পেইন করেই যাচ্ছে। এই অভিযাত্রীদের থেকে রীতিমতো সইসাবুদসহ ‘টাইটানে করে সাগরের তলদেশে গিয়ে কিছু হলে কোম্পানি দায়ী থাকবে না’ মর্মে প্রত্যয়ন নিয়ে রেখেছে।
ড. স্কট লায়নস বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কে আমিগডালা নামের একটি অংশ থাকে, যা যেকোনো কাজের নেতিবাচক পরিণতির ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেয়। আর এর ফলে হঠাৎ প্রবাহিত হয় হরমোনের স্রোত। এসব হরমোনের মধ্যে আছে ডোপামিন, টেস্টোস্টেরন, নোরেপিনেফ্রিন, অ্যাড্রিনালিন আর সেরোটনিন।’ এতে সাময়িকভাবে তীব্র রকমের উত্তেজনা, শক্তিমত্তা আর ভ্রুক্ষেপহীন মনোভাব জাগে। আর ধনী ব্যক্তিদের একঘেয়ে জীবনে এ এক অত্যন্ত আরাধ্য বিষয় তাঁদের জন্য।
অ্যাডভেঞ্চার একটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু মাল্টিমিলিওনিয়ারদের উত্তেজনাকামী মনের খোরাক মেটাতে গিয়ে এই টাইটানিক ট্যুরিজমের মতো আলট্রা-ভেঞ্চারের যে অযৌক্তিক প্রবণতা তৈরি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে, তা পর্যটনের এক অসুস্থ রূপ। এসব ধনকুবেরদের সত্যিকারের অভিযাত্রীদের নিরাপত্তা ও রসদ জোগাড়ে পৃষ্ঠপোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করলে বরং এই অর্থ কাজে লাগবে। নিজেরাও সেসব অভিযাত্রায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতে পারেন তাঁরা, আর তা টাকা ঢেলে শর্টকাটে নয়, বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধানে লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে। তাহলে হয়তো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আর দেখতে হবে না বিশ্ববাসীকে।
হিরো ইমেজ: রয়টার্স