ভাইরাল ট্রেন্ড: আপনি কি 'ছাতিম লাভার' নাকি 'ছাতিম হেটার'?
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। ছয় ঋতুর এই দেশে বর্ষাকাল আসে কদমফুলের হাত ধরে, আর শরতের সুবাস একাকার হয়ে যায় ভোরে ঝরে পড়া শিউলির সুঘ্রাণে। সেই নিয়মে হেমন্তের সন্ধ্যাগুলো নিয়ে আসে ছাতিমের সুতীব্র সুবাস। চিরচেনা এই গাছটি আমরা চিনি সবাই। তবে সম্প্রতি ঢাকাসহ বড় বড় নগর ও শহরে কয়েক বছর আগে রোপণ করা ছাতিম গাছগুলো বেশ বড় হয়ে উঠেছে। আর হেমন্ত এলেই ঝাঁজালো মিষ্টি সৌরভে মাতাল করে দিচ্ছে যান্ত্রিক নগরের পথচলতি আমাদেরকে। তবে এই সামাজিক মাধ্যমের যুগে কোনো এক কারণে হঠাৎই ভাইরাল হয়ে ওঠে খুব চেনা কিছু। যেমন সপ্তাহখানিক ধরে ফেসবুকে তর্ক বিতর্ক আর মিমসের জোয়ার এসেছে ছাতিম গাছ নিয়ে। কেউ বলছেন তিনি ছাতিম লাভার, আবার কেউ বলছেন তিনি ছাতিম হেটার।

সপ্তাহখানিক ধরে ফেসবুকে তর্ক বিতর্ক আর মিমসের জোয়ার এসেছে ছাতিম গাছ নিয়ে
সপ্তাহখানিক ধরে ফেসবুকে তর্ক বিতর্ক আর মিমসের জোয়ার এসেছে ছাতিম গাছ নিয়ে

ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় এখন ছাতিমের রাজত্ব।  শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনের সড়ক, মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা,বাংলা একাডেমির সামনে জাতীয় তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণ, জাতীয় প্রেসক্লাব, আব্দুল গনি রোড আর হাতিরঝিলের আশেপাশে মিলছে ছাতিমের দেখা। আরো অনেক সড়কের পাশ দিয়ে গেলেই ঘ্রাণ পাওয়া যায় এই গাছের থোকা থোকা ফুলের।
পথ চলতে চোখে পড়ে না এই ফুল। তার কারণ, লম্বা ছাতিম গাছে ফুটে থাকা এই ফুলের গুচ্ছগুলো দৃষ্টিসীমার বেশ ওপরে থাকে। তবে নতুন গাছগুলো মাত্র ফুল দিচ্ছে এখন। আর তাই ছাতিম ফুলের সঙ্গে ছবি তোলার দুর্লভ সুযোগ মিলছে নগরীর বুকে। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই ছাতিমে সঙ্গে সেলফি আর অ্যাস্থেটিক সব ছবি দিচ্ছেন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে।

বিজ্ঞাপন

ছাতিমের ফুলের চারিদিক ঘিরে থাকে কয়েকটি পাতা। আর এই জন্য এই গাছের নাম সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণা। পাতা সহযোগে ছাতার আমেজ দেয় বলেই কি এই গাছের নাম ছাতিম? গ্রামবাংলায় একসময় প্রচুর ছাতিম দেখা যেত। আর এর সঙ্গে আবার শ্যাওড়া বা তালগাছের মতো নানা ভূতের গল্প জড়িয়ে আছে। পুরনো ছাতিম গাছগুলোর নিচ দিয়ে আগের দিনে সন্ধ্যার পর আর কেউ সহজে যাতায়াত করতে চাইত না। তবে এই ছাতিম গাছ কিন্তু শুধু বাংলাদেশে হয় না, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও দেখা মেলে এই গাছের।

 গ্রামবাংলায় একসময় প্রচুর ছাতিম দেখা যেত
গ্রামবাংলায় একসময় প্রচুর ছাতিম দেখা যেত

এখন প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। আপনি কি ছাতিম লাভার নাকি হেটার? ছাতিমের গন্ধটা আসলে ঠিক বেলি বা গোলাপের মতো মিষ্টি না। এর মধ্যে আছে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঝাঁজালো ভাব। আর এজন্যই অনেকে এর ঘ্রাণ পছন্দ করেন না। আবার এই অন্যরকম সুবাসের নেশায় মাতোয়ারা হন অনেকেই। আর এই নিয়েই ফেসবুকে চলছে ভাইরাল সব পোস্ট আর মিমস। তবে ছাতিমঅসহ এই ঋতুর এমন সব ফুলের রেণু থেকে হতে পারে তীব্র অ্যালার্জি। এই পলেন অ্যালার্জি অনেকসময় জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই ছাতিম বিলাস করার আগে আপনার অ্যালার্জি ট্রিগাগুলো জেনে নিতে হবে অবশ্যই। তীব্র ঘ্রাণেও অনেকের অ্যালার্জি আর মাইগ্রেনের সমস্যা হতে পারে। সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।

বিজ্ঞাপন

ছাতিম লাভারদের দল কিন্তু বেশ ভারী। আর এই তালিকায় আছেন বাঘা বাঘা সব কবি ও সাহিত্যিক।
'অপু বলিল, কী ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে, না দিদি? তাহাদের মা বলিল, তাহাদের জ্যেঠামশায়ের ভিটার পিছনে ছাতিম গাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র নৈশবায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাতে বেনুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালার ডালে পাতায় চিকচিক করছে'।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসের এই ছাতিম ফুলের বর্ণনা পড়ে কার না মন উদাস হয়!
অনেকেরই জানা আছে, শান্তি নিকেতনে সমাবর্তনে ছাতিমের পাতা উপহার দেওয়ার চল আছে। রবি ঠাকুরও ছিলেন ছাতিম লাভার। লিখে গিয়েছেন, 'ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি। সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি'।

ছাতিম লাভারদের দল কিন্তু বেশ ভারী
ছাতিম লাভারদের দল কিন্তু বেশ ভারী

বিভূতিভূষণের মায়াময় লেখনীতে আরও কিছু জায়গায় মেলে ছাতিমের সুবাস। তাঁর আরণ্যক-এ আছে,'পাহাড়ের উপরে ঘন বন ঠেলিয়া কিছুদূর উঠিতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল, গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত প্রথমটা ধরিতে পারি নাই, তারপরে চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধন্ঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস। সে কি দুচারটি ছাতিম গাছ! সপ্তপর্ণের বন, সপ্তপর্ণ আর কেলিকদম্ব কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুনপাতার মতো বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবাঁকা ডালপালাওয়ালা বনস্পতিশ্রেণীর বৃক্ষ'।

সে যাই হোক, ছাতিম গাছগুলো এখন হেমন্তের আগমনীকালে নগরীর প্রাণ হয়ে উঠেছে। আপনি ছাতিম লাভার বা হেটার যাই হোন না কেন, ছাতিম এখন আমাদের নাগরিক সন্ধ্যাগুলো সুবাসী আবেশে ভরিয়ে তুলছে, সে কথা মানতেই হবে।

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৪২
বিজ্ঞাপন