১৪৫ বছর ধরে যেভাবে টিকে আছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই মানসিক হাসপাতাল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মানসিকভাবে অসুস্থ মানে পাগল নয়—এই সহজ সত্য বুঝতে মানুষের বহু সময়  লেগেছে এবং এখনো লাগছে। আর তার দাম চোকাতে হচ্ছে সেই সব অসুস্থ মানুষ ও তাঁদের পরিবারকে, সমাজ যাঁদের পাগল বলে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের একটা গান আছে এমন, ‘পাগলাগারদ কোথায় আছে নেই বুঝি তা জানা/ ঘোড়ার কি ডিম হয় সেই ডিমের হয় ছানা?’

১৪৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দামোদর ঔষধালয়ের নিশি চন্দ্র দাশের অফিস
১৪৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দামোদর ঔষধালয়ের নিশি চন্দ্র দাশের অফিস

ফিরে আসার সময় বাইরের এক চায়ের দোকানে বসেছিলাম। সেখানে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কয়েকজন স্থানীয় বয়স্ক মানুষ জমিয়ে আলাপ করা শুরু করলেন। তাঁদের মুখ থেকেই শুনলাম, কীভাবে সুস্থ-সবল মানুষকে জমি বা অন্য কোনো বিবাদের জেরে মানসিক রোগী বানিয়ে এই হাসপাতালে জোর করে ভর্তি করা হয়। অন্য রোগীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কিছুদিন পর তাঁরা সত্যি সত্যি মানসিক রোগীতে পরিণত হন।

বিজ্ঞাপন

‘পাগল’, ‘পাগলাগারদ’ ইত্যাদি শব্দ আমরা পাল্টে তুলনামূলক মানবিক শব্দ ‘মানসিক রোগী’, ‘মানসিক হাসপাতাল’ করেছি। কিন্তু ছিন্নমূল রোগী দেখলে রাস্তায় তাঁকে উত্ত্যক্ত করা বা ঠাট্টা করে ‘মানসিক রোগী’ বলার মানসিকতা কি পাল্টেছে? তাঁদের ‘পাগল’ বলে বাচ্চারা ঢিল ছুড়ছে আর বড়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন, এমন দৃশ্য প্রায় দেখা যেত। শহর-গ্রামে এখনো নিশ্চয়ই এমন হয়। আপনার কোনো প্রিয়জনও কিন্তু এমন ঢিলের আঘাত কিংবা বিদ্রুপে বিপন্ন হতে পারেন!

এটাই বাংলাদেশের প্রথম মানিসক রোগীদের হাসপাতাল
এটাই বাংলাদেশের প্রথম মানিসক রোগীদের হাসপাতাল

যাহোক, এখন থেকে প্রায় ১৪৪ বছর আগে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দিতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে গড়ে ওঠে দামোদর ঔষধালয়। কবিরাজ নিশি চন্দ্র দাশের গড়ে তোলা এ চিকিৎসালয়ে মানসিক রোগীদের সুস্থ করতে চলে পুরোদস্তর আযুর্বেদিক চিকিৎসা। তাদের এ চিকিৎসায় স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত তিন সহস্রাধিক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছে। চট্টগ্রাম-কক্সাবাজার মহাসড়ক থেকে ১ কিলোমিটার পশ্চিমে জোয়ারা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ চিকিৎসালয় ধীরে ধীরে পরিচিতি পায় ‘জোয়ারার পাগলাগারদ’ নামে।

বিজ্ঞাপন

১৮৮০ সালে একর জমিজুড়ে সরকারি অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। দামোদর ঔষধালয় হিসেবে নামকরণ করা হলেও এটি প্রথমে নিশি বৈদ্যের বাড়ি এবং আরও পরে ধীরে ধীরে জোয়ারার পাগলাগারদ নামে পরিচিতি পায়। সেই  থেকে এখনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে এটি।

তৎকালীন পাকিস্তান আমলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে চিকিৎসাসেবা দিত প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিশি বৈদ্যের গড়ে তোলা এ পাগলাগারদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধ্বংস করা হয় কবিরাজি ওষুধের কারখানাও। দেশ স্বাধীনের পর ধারদেনা করে পুনরায় এই মানসিক হাসপাতাল চালু করা হলেও তা আর আগের রূপ ফিরে পায়নি। নিশি বৈদ্যের বাড়ির ঐতিহ্য বজায় রাখতে প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেছেন কবিরাজ নিশি রঞ্জন দাশের ছেলে কবিরাজ চিত্ত রঞ্জন দাশ।

সাধারণ রোগী ভর্তি ফি বাবদ সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা নেওয়া হয়। কেউ ভর্তি করিয়ে ভরণপোষণ চালায়, আবার  কেউ ভরণপোষণ তো দূরের কথা, রোগীর খোঁজই নেন না।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি বিশাল আয়তনের মাটির ঘরে চালানো হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। ঘর দুটিতে ছোট ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে রোগীদের। রোগীদের রুমগুলো স্যাঁতসেঁতে ও অপরিষ্কার। দেখে নিজেরই পাগল হওয়ার দশা! আছেন কেয়ারটেকার; তিনি খাওয়া-দাওয়াসহ রোগীদের যাবতীয় বিষয়াদি দেখছেন সুচারুভাবে।

এই হাসপাতলের তত্ত্ববধানে বর্তমানে আছেন পীযুষ সেন (বাঁয়ে)
এই হাসপাতলের তত্ত্ববধানে বর্তমানে আছেন পীযুষ সেন (বাঁয়ে)

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজার রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অধিক জটিল রোগীর চিকিৎসা সম্ভব না হলে তাঁদের পাবনা মানসিক হাসপাতাল কিংবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা ক্ষোভের সঙ্গে আরও জানান, কালের সাক্ষী হয়ে থাকা এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী কিংবা কোনো সরকারের দায়িত্বশীল কারও নজরে আসেনি। ব্যক্তিগত দানে হলেও এটি দেশের প্রথম মানসিক ভারসাম্যহীনদের হাসপাতাল।

বাংলাদেশের মানসিক ভারসাম্যহীনদের একমাত্র আয়ুর্বেদিক চিকিৎসালয়ের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক পীযুষ সেন জানান, তাঁদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বৃক্ষ, গুল্ম, লতা-পাতা ও বিভিন্ন ঔষধি দ্রব্যের সাহায্যে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা হয় চিকিৎসার প্রয়োজন অনুযায়ী। কোনো ধরনের রাসায়নিক বা অন্য কোনো ধরনের ওষুধ রোগীদের দেওয়া হয় না।

হাসপাতালে একজন রোগী
হাসপাতালে একজন রোগী

পীযুষ সেন আরও জানান, প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া পাগলদের সুস্থ হওয়ার রেকর্ড ৮০ শতাংশ। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যবস্থা না থাকা প্রসঙ্গে পীযুষ সেন জানান, সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিভাগ বা সংস্থা থেকে কখনো কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে ইচ্ছা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েও তেমন সাড়া মেলেনি। রোগীদের চিকিৎসায় পাওয়া অর্থে কোনোমতে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। বাণিজ্যিক নয়, কেবল সেবার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৪৫ বছর ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানসিক বিকারগ্রস্তদের রোগ নিরাময়ে কবিরাজি ওষুধপথ্য দিয়ে যতটুকু উপকার করা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অন্যান্য ওষুধ দিয়ে তা সম্ভব নয় বলেও দাবি করেন তিনি। বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীন সাতজন পুরুষ ও একজন নারী চিকিৎসাধীন আছেন এখানে। ১৪৫ বছরে কোনোমতে  টিকে আছে দেশের প্রথম ‘জোয়ারার পাগলাগারদ’।

 ছবি: কমল দাশ

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ১৫: ০০
বিজ্ঞাপন