৩০ বছর আগে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের হাত ধরে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশের শতরঞ্জি। এবার ঢাকায় শুরু হলো কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের নতুন আউটলেট ‘শতরঞ্জি’।
এই নতুন অভিযাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজন করা হয় প্রীতিসম্মেলন। সোমবার ধানমন্ডির শুক্রাবাদে নন্দিনী নামের ভবনে কারুশিল্প প্রদর্শন ও বিপণনকেন্দ্রটি নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে। এ আয়োজনের বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, কবি নির্মলেন্দু গুণ ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। অনুষ্ঠানে শতরঞ্জির ঐতিহ্য ও বিবর্তনের পুরো ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
কারুপণ্য লিমিটেড এখন আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করছে ঐতিহ্যবাহী দেশীয় কারুপণ্য। এর পেছনে বিগত তিন দশক অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম। পারিবারিক সহযোগিতা আর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় রংপুরের শতরঞ্জিকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের নাম ও শতরঞ্জি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছে বিশ্ববাজারে।
অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যিক আনিসুল বলেন, ‘আমাদের রংপুর হলো রঙের পুর। আবার শতরঞ্জি শব্দটি এমন, যেটি রঞ্জিত করে, যেখানে একটি রং নেই, শত ধরনের রঙের মেলা। রংপুরের এই ঐতিহ্যকে বিশ্ববাজারে এভাবে তুলে ধরার জন্য আমরা সবাই কৃতজ্ঞ কারুপণ্যের কাছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ, সেলিমের মতো উদ্যোক্তা রয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ুক।’
১০ বছর ধরে রংপুর কারুপণ্য লিমিটেড নিয়মিতভাবে জাতীয় রপ্তানি পুরস্কার পাচ্ছে। ২০২০-২১ সালে কারুপণ্য ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। কারুপণ্যের কারাখানায় বর্তমানে সাড়ে সাত হাজার মানুষ কাজ করেন। ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করেন বাড়ি থেকে। তাঁদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ নারী।
কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম বলেন, ‘কারুপণ্যের শতরঞ্জিকে সবার কাছে উপস্থাপন করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। তাই আজ এত বড় স্বীকৃতি পেয়েছি। কারুপণ্য যদি তার এ অগ্রযাত্রা সামনে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে হাজার হাজার কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। আমরা বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যেতে চাই।’
পুরোনো ডিজাইন তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে শতরঞ্জিতে কিছুটা নতুনত্ব আনা হয়েছে। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে শতরঞ্জিতে কালার কম্বিনেশন ও মোটিফের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানান কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের পরিচালক সুরাফা হোসেন শিলা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা দেশের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বাজার সচল হোক। শতরঞ্জি যদি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়, তাহলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানীয় পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। কামার-কুমার থেকে শুরু করে তাঁতি, জেলে—সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। বিদেশি পণ্যের চেয়ে দেশি পণ্য কিনুক সবাই। এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত হতে পারে এসব পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়েই।’
শুধু শতরঞ্জি নয়, পাশাপাশি দেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের সম্ভাবনার জায়গাকে জোরদার করতে তাঁরা অন্যান্য পণ্য নিয়েও কাজ করছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পগুলোকে দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয় করার উদ্যোগকে সফল করতে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড নতুনভাবে এই আউটলেট সাজিয়েছে। দুটি ফ্লোরজুড়ে রয়েছে নানা ধরনের পণ্য। কচুরিপানা, বাঁশ, খড়, জল-পাতা, ভুট্টার খোসা, পাম ফাইবার, পাট, কাশিয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি করা হয়েছে নানা ধরনের লাইফস্টাইল পণ্য—টেবিল ম্যাট, বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের বাস্কেট, ওয়াল ম্যাট, ডোর ম্যাট, পাপোশ ইত্যাদি। কামার-কুমারদের টিকিয়ে রাখতে তাদের তৈরি বঁটি, ছুরি, নানা ধরনের মৃৎপাত্র ও খেলনা এখানে রাখা হয়েছে। আরও রয়েছে বাতিল কাপড় দিয়ে তৈরি নানা ধরনের পণ্য।
রংপুরের শতরঞ্জির জিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্তি বিশ্ববাজারে এ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এতে রপ্তানিও বাড়াবে। একই সঙ্গে এসব পণ্যের ৩০ শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যাবে।
ছবি : লেখক