পাহাইড়া বরফ! লাগব, পাহাইড়া বরফ! এই হাঁকডাক আজকের প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত অচেনা হলেও বর্ষীয়ান অনেকে তা শুনলেই ইফতারের ঠিক আগে বরফকল থেকে আনা, গলে যাওয়ার ভয়ে চেরাইকলের কাঠের গুঁড়ায় ঢাকা বিশাল বরফের চাঙড় থেকে বরফওয়ালাদের হাতুড়ি, ছেনি দিয়ে কেটে দেওয়া বরফের বিশাল টুকরা ঘাড়ে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিতে ডুবে যাবেন। ফ্রিজের বালাই না থাকায় ইফতারে হিমশীতল শরবত বানাতে এই পাহাইড়া বরফই ছিল তখন সম্বল। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকমের গুড়ের সঙ্গে তেঁতুল, লেবু, বেল, তোকমা বা বাঙ্গির শরবত হতো এই বরফসহযোগে। পুরান ঢাকায় আবার লাচ্ছি, দুধ বাদামের শরবত বা ফালুদাতেও সংগত দিত এই পাহাইড়া বরফ।
আজকাল রোজা, সাহরি, ইফতারের কতই না নাম দেওয়া হচ্ছে, চলছে সহি-গলদের দ্বন্দ্ব। অথচ সেই শত শত বছর ধরে ইফতারকে রোজাখুলাই বলা হতো পুরান ঢাকায়। বৃহত্তর ঢাকার বিক্রমপুরে আবার সাহরিকে বলা হতো সরকাই। রাত ঢলে এলেই বাতি জ্বলত পাকঘরে। মেয়ে-বউরা গরম গরম ভাত রেঁধে নিতেন আর আগেই তৈরি উপাদেয় সব মাছ বা ডিমের সালুন আদান-প্রদান চলত প্রতিবেশীদের মধ্যে সেই শেষ রাতেও। ধর্ম বা সম্প্রদায় পরিচয় ভুলে গ্রামের ছেলেবুড়ো সবাই মেতে উঠত সরকাই খাবার আনন্দে।
বৃহত্তর সিলেটে আবার এই সাহরিকে বলা হয় ফতা। ছোটরা ছড়া কাটত, লতা দিয়া ফতা খাইতা না? এই ফতার দস্তরখানে থাকত মাছের বিরান, কখনোবা মাংসের পদ। আবার সিলেট অঞ্চলে সবজি দিয়ে রাঁধা পাতলা সাদা খিচুড়ি ছাড়া ইফতার হবেই না। সঙ্গে শাকের বড়া চলতে পারে।
পুরান ঢাকায় আবার রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগাতে শেষ রাতে কাসিদার আয়োজন হতো সড়কে, গলিতে। প্রথম ১৫ দিন পরিবেশিত হতো খুশ আমদিদ মাহে রমজান ধাঁচের গান আর শেষ ১৫ দিন আল বিদা মাহে রমজানের করুণ সুর থাকত গায়কিতে। এ অঞ্চলে আবার সাহরিতে কোর্মাজাতীয় পদ আর দুধে ভেজানো নিমসুখা রুটির খুব কদর ছিল। ইফতারে জনপ্রিয় ছিল হরেক কাবাব, হালিম, দইবড়া, জিলাপি, রসবড়ি, ফালুদা, পনির ভাজা। সারা দেশেই মুড়ির সঙ্গে ফুলুরি আর ছোলাসহযোগে ইফতার যুগ যুগ ধরেই সবার প্রিয়। মাগরিবের আজান দিলে দেশের সব জায়গায়, হাটে-ঘাটে, দোকানপাটে, মসজিদে যে মুড়িমাখার আয়োজন থাকে, তাতে অঘোষিত নিমন্ত্রণ থাকে শ্রেণি-ধর্ম নির্বিশেষে উপস্থিত সবারই।
উত্তরবঙ্গে শেষ রাতের খাবারকে অনেকে পোয়াত্তে বলতেন, এখনো বলেন। এ সময়ে দুধভাত আর গরু মহিষের মাংসের পদ খুব প্রিয় ছিল সবার, এই স্মৃতিই রোমন্থন করলেন বর্ষীয়ান অনেকে। দুধভাত অবশ্য অঞ্চলনির্বিশেষে সবাই ভালোবাসেন সাহরিতে যুগ যুগ ধরে। চট্টগ্রামে শিরমাল রুটি খুবই পছন্দ সবার ইফতারের সময়। অনেক সময় হালিম বা বুন্দিয়ার সঙ্গে খাওয়া হয় এই রুটি। সেখানে শেষ রাতের খাওয়ার আয়োজনটি ফোয়াইত্তে বলে পরিচিত অনেকের কাছে।
এদিকে জামালপুরে বুট বিরান, উত্তরবঙ্গে অনেক অঞ্চলে চাল বিরান ছাড়া ইফতার জমেই না। এই আমাদের বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে যুগে যুগে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া সাহরি, ইফতার আর রমজান মাস। সংযমের এই মাসে যেন আমরা নিজেরা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার্ত আর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করি এটাই কাম্য। অহেতুক বিতর্ক আর ফ্যাসাদ পেছনে ফেলে জয় হোক সম্প্রীতির, জয় হোক খাদ্যসংস্কৃতির বিনি সুতার মালায় গাঁথা দেশের সব মানুষের।
ছবি: শামীমা মজুমদার