আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস: আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ’—এই গানের বোল বাঁধতে গিয়ে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কি কোনো দিন ভেবেছিলেন যে মানুষ একসময় শুধুই আকাশের ঠিকানায়, অর্থাৎ অন্তর্জালে (ই-মেইলে) চিঠি লিখবে! শেরশাহের ঘোড়ার ডাক প্রচলনের আগে কীভাবে চিঠি আদান-প্রদান হতো, তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও আজকাল দাপ্তরিক কাজের নথি বা আবেদনপত্রের ঝক্কি ছাড়া কেউ ডাকঘরে যে আর যায় না, সেটি সবার জানা। অথচ একসময়ে দূরে থাকা আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যম ছিল চিঠি। শুধু দূরে নয়, অন্তরের খুব কাছের কাউকে মুখে না বলতে পারা কথাগুলো সযত্নে সাজিয়ে নেওয়া হতো চিঠিতে। একেকটি চিঠিতে কত গল্প, কত যে ইতিহাস থাকত! আর থাকত টইটম্বুর আবেগ।

চিঠি মানে কুশল বিনিময়, গুরুত্বপূর্ণ খবর আদান-প্রদান, মনের কথা জানানো, সুসংবাদ অথবা দুঃসংবাদ—সবকিছু ছিল একসময়ে। বাড়িতে বাড়িতে ডাকহরকরা বা পোস্টম্যান পৌঁছে দিয়ে আসতেন খামে ভরা চিঠি। তাতে বসানো দেশ-বিদেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের প্রচলনও তুঙ্গে ছিল শিশু-কিশোরদের মধ্যে। পত্রমিতালি হতো দেশ-বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গে। চিঠি নিয়ে আসত চাকরির খবর, পদোন্নতির সংবাদ, নতুন প্রাণের আগমনবার্তা, নয়তো বিয়ের নেমন্তন্ন রূপে বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। আবার কোনো বিপদ, অসুস্থতা, নয়তো কারও মৃত্যুসংবাদ নিয়ে আসত কোনো কোনো সর্বনাশা চিঠি।

প্রবাসী সন্তানের চিঠির পথ চেয়ে বসে থাকতেন মা। কখনোবা নীল খামে ভরা চিঠির ভাঁজে সুগন্ধি মাখিয়ে বা গোলাপের পাপড়ি গুঁজে ভালোবাসার বার্তা যেত প্রিয় মানুষটির কাছে। এখনো অতীতবিলাসী বহু মানুষের কাছে সযত্নে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়া আছে গুচ্ছের সব চিঠি। হয়তো যিনি লিখেছেন, সেই মানুষ আর নেই, তবু চিঠিতে রয়ে গেছে তাঁর আবেগময় কথাগুলো।

বিজ্ঞাপন

যুগে যুগে চিঠির ভাষার সাহিত্যমূল্য কিন্তু আমাদের অবাক করেছে, করেছে মুগ্ধ। চিঠির আদলে লেখা রবিঠাকুরের গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধনহারা’র মতো পত্রোপন্যাস তো বটেই, বিভিন্ন সময়ে লেখা জীবননিষ্ঠ চিঠিতে একেকটি সময়ের আখ্যান লেখা থাকে। অশভিচে জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি বন্দীদের লেখা চিঠির সংকলন নিয়ে লেখা বইগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করছে সেই দুঃসহ সময়ের। নেলসন ম্যান্ডেলা আর আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য কারাবরণের সময়ে লেখা চিঠিগুলো যেন একেকটি প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল। মহাত্মা গান্ধী, আলবার্ট আইনস্টাইন, জওহরলাল নেহরু এমনকি হিটলার, মুসোলিনির চিঠিগুলো আজও আমাদের ইতিহাসের পাঠ দেয়। শুধু গুরুগম্ভীর চিঠি নয়, প্রিয়জনের কাছে লেখা নেপোলিয়ন, রাজা হেনরি, সুরস্রষ্টা বিটোভেন, শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর লেখা বিখ্যাত প্রেমপত্রগুলো তাঁদের প্রেমময় অনুভূতির এক অনন্য প্রকাশ। কিংবা ভাই থিওকে লেখা শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চিঠিগুলো। আহা কত কী যে রয়েছে লেখা আখরে আখরে!

আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার এদিকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধনে অদ্ভুত সুললিত সব চিঠি লিখতেন প্রিয় সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীকে। সুকান্তের প্রতিবাদী চেতনাভরা চিঠির সংকলন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের চরম অর্থনৈতিক সংকটকালে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিগুলো, রবীন্দ্রসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কি নিয়ে বিশ্বভারতীর বিমাতাসুলভ আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর লেখা দাপ্তরিক ও অসম্ভব অভিমানী সব চিঠি—এ সবই আমাদের মনোজগতে প্রবল অনুরণন তোলে।

এখনো হয়তো ঘরের কোনো দেরাজে বা আলমারির ওপরে কোনো বাক্সে রাখা আছে আমাদের বাবা, মা, মাতামহী, পিতামহের লেখা স্নেহময় চিঠি। কোনো এক অজানা কোনায় খুঁজে দেখলে লাল ফিতায় বাঁধা নীল খামের চোখভেজানো চিঠিগুলো পেলেও পাওয়া যেতে পারে বর্ষীয়ান কারও বাড়িতে। আজকের এই অস্থির সময়ে আমরা চিঠি লিখতে ভুলে গেছি। চিঠি শুধু এখন ইতিহাসের পাতায়, গল্প–উপন্যাসে আর কবিতার উপমায়। কারণ, এখন ই–মেইলও যথেষ্ট কেজো। সেখানে খুব দরকারি কথা ছাড়া কিছুই বলতে গেলে থাকে না। তার ওপর রয়েছে টেক্সট মেসেজ বা খুদে বার্তা।

বিজ্ঞাপন

আজ ১ সেপ্টেম্বর। দিনটি আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস হিসেবে স্বীকৃত। আজকের দিনে সুন্দর কাগজে চমৎকার কোনো কলমে শুধু সবচেয়ে প্রিয় একজনকে না হয় চিঠি লেখা যাক মনখুলে। যে চিঠিতে একটি আন্তরিক সম্বোধন থাকবে, চিঠির পরতে পরতে আবেগ থাকবে, না বলা কথা থাকবে, আর শেষে নিজের নাম স্বাক্ষর করার আগে লেখা থাকবে ‘ইতি তোমার’ বা ‘আপনার স্নেহধন্য’। আজকের এই ডিজিটাল জমানায় এমন একটা চিঠি পুরোনো দিনের মানুষটিকে উদ্বেল করবে বৈকি! হয়ে উঠবেন স্মৃতিকাতর।

হয়তো মনে পড়ে যাবে তাঁদের যৌবনের প্রিয় সেই গান, বনশ্রী সেনগুপ্তের গাওয়া—আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম/রঙিন খামে যত্নে লেখা আমারই নাম।
বাবাকে হয়তো কোনো দিন বলা হয়নি কতটা ভালোবাসি তাঁকে, মাকে হয়তো বলা হয়নি যে সব সময় আমি পাশে আছি আর তিনি যেন তাঁর নিজের যত্ন নেন একটু।
হয়তো ১৫-২০ বছরের দাম্পত্য জীবন কেটে গেছে, এখন আর বলা হয় না কোন রঙে তাকে খুব মানায়, অথবা সে হাসলে ঠিক কেমন অনুভূতি হয়।

হয়তো কোনো এক সামান্য কারণে খুব প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কেমন যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু বহুদিন কেটে গেছে বলে ফোন আর করা হয় না। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধুর তালিকাতে নিশ্চুপ উপস্থিতিটুকু আছে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে লিখে ফেলা যাক চিঠিটা। হৃদয় নিংড়ানো, হাতে লেখা চিঠি পেলে প্রিয় মানুষটির মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। আজকের এই চিঠি দিবসের সার্থকতা কিন্তু সেখানেই।

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০: ০০
বিজ্ঞাপন