সারা বিশ্বে আজকের দিনটি মে দিবস বা 'মে ডে' বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে শ্রদ্ধাভরে পালিত হয়। শুরুর দিকে পয়লা মে-তে উদযাপিত এ দিবসটি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও সমাজতান্ত্রিক সংস্থা পালন করত। কিন্তু ইতিহাস বলে, এর নেপথ্যে আসল প্রতিবাদটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বর্ণবিদ্বেষ, নিপীড়ন আর অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এক রক্তক্ষয়ী উপাখ্যান থেকেই এই মে দিবসের জন্ম।
মে দিবস এলেই আমাদের দেশে ভারতের গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অনুবাদ করা 'জন হেনরি' নামের লোকগীতি বিভিন্ন আয়োজনে সমবেতভাবে পরিবেশিত হয়। প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর এই গানটিকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সব দেশেই গীতিকাগুলোতে বাস্তবের কাহিনীর সাথে সুদীর্ঘ অতীতের কিছু মনের মাধুরী মেশানো গল্প মিশে থাকে। সময়ের সঙ্গে সেখানে সংযোজন আর বিয়োজন ঘটে। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, বলাই বাহুল্য। জন হেনরিকে নিয়ে লেখা মর্মস্পর্শী গান বিশ্ব জুড়ে মে দিবসের অনুভূতি আর আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের শুরুর গল্পের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই মার্কিন কিংবদন্তির নাম। কিন্তু আসলেই কি এই নামে কেউ ছিলেন?
মূল আন্দোলন আমেরিকার শিকাগো শহরে দানা বেঁধে উঠলেও জন হেনরির কাহিনীটি শিকাগো আন্দোলনের বেশ আগের। আঠারোশ ষাট দশকের কথা। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার পাথুরে পাহাড়ের বুকে সুড়ঙ্গ কেটে রেলপথ বসানোর কাজ চলছে। প্রতিদিনের কাজের মজুরি পঁচিশ সেন্ট। কোম্পানি আরও দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ও শ্রমিক বাবদ খরচ কমাবার জন্য সদ্য আবিষ্কৃত স্টিম ড্রিল মেশিন নিয়ে আসে। এই মেশিন মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত পাথর কাটবে। কোম্পানির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন শ্রমিক নেতা জন হেনরিসহ আরো অনেকে। কারণ কায়িক পরিশ্রমের এই কাজ করেই উপার্জন করে সারা গ্রামবাসী।
শ্বেতাঙ্গ ঠিকাদারের উদ্দেশ্যে জন হেনরি বলেন, সুড়ঙ্গ কাটার কাজে মানুষই সেরা, মেশিন নয়। হেনরিরকথা শুনে বিদ্রুপ করে ঠিকাদার। মেশিনের চেয়ে যে মানুষ বড়, তা হেনরিকেই প্রমাণ করেদেখাতে বলেন। বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে স্টিম ড্রিলমেশিনের সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন জন হেনরি তাঁর প্রিয় হাতুড়িটি সম্বল করে। কোনো এক ভোরে শুরু হয় মানুষের সঙ্গে মেশিনের সেই অসম লড়াই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ চলতে থাকে। সূর্যাস্ত হওয়ার আগে দেখা যায়,পাথর কেটে টানেলের ১৪ ফুট গভীরে প্রবেশ করেছেন জন হেনরি। আর স্টিম ড্রিল মেশিন প্রবেশ করেছে মাত্র ৮ ফুট। এক অদম্য মানুষ ও তাঁর মরণপণ সংগ্রামের কাছে হেরে যায় মানুষেরই তৈরি স্ট্রিম ড্রিল। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের কাছে সম্মানের লড়াইয়ে হেরে যায় শেতাঙ্গ ঠিকাদাররা।
হেনরির জয়ের খবর টানেলের ভেতর থেকে বাইরে আসে। আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন টানেলেরবাইরে অপেক্ষা করা হাজার হাজার কৃষাঙ্গ শ্রমিক। হেনরিকে কাঁধে করে বাইরে আনার জন্য সকলে ছুটে যায় টানেলের ভেতরে। কিন্তু দেখা যায়, বিশ্বের সমস্ত মেহনতি মানুষের রক্ত, ঘাম ও শ্রমের বিজয় পতাকা পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অস্তমিত সূর্যের লালিমায় মাখা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে, টানেলের মধ্যেই শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন অপরাজেয় জন হেনরি। গানের সুরে এই গল্প শুনতে শুনতে কখন যে চোখে পানি চলে আসে, তা টেরই পাই না আমরা।
কিন্তু এদিকে অনেক গবেষক বলেন জন হেনরি কৃষাঙ্গদের তৈরি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। বাস্তবে আদৌ জন হেনরি নামের কোনো শ্রমিকের অস্তিত্ব ছিল না। শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় কৃষাঙ্গ শ্রমিকরা নিজেদের অনুপ্রাণিত করার জন্য এই শক্তিশালী চরিত্রটি হাজির করেন গল্পের মাধ্যমে। এসব বিতর্কের কারণে এখনো প্রচুর গবেষণা চলে জন হেনরির অস্তিত্ব নিয়ে।
জন হেনরির বিজয়গাঁথা নিয়ে লেখা গান 'দ্য ব্যালাড অব জন হেনরি' অনেকটা মে দিবসের গান হিসেবে সমাদৃত সকলের কাছে। এই গান নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এভাবে সারা বিশ্বে এই ঘটনাটি ধীরে ধীরে গীতিকা আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের লোকসাহিত্য গবেষকদের মতে এই গানটি আমেরিকার সবচেয়ে বেশি গবেষণাকৃত লোকগান। আমেরিকান লেখক ও গবেষক স্কট রেনল্ড নেলসন জন হেনরিকে নিয়ে 'স্টিল ড্রাইভিন ম্যান: জন হেনরি, দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব অ্যান অ্যামেরিকান লেজেন্ড' নামে একটি গবেষণামূলক বই লেখেন। বইটিতে নেলসন প্রমাণ করেন, জন হেনরি নামে সত্যিই একজন রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে জন হেনরির মূর্তি আছে। স্কুলে পড়ানোও হয়ে তাঁকে নিয়ে। গল্পে, গানে, চিত্রকর্মে আর এখন এআই জেনারেটেড ইমেজেও জন হেনরি আছেন মে দিবসের প্রাণপুরুষ হয়ে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে।
সূত্র: ভার্জিনিয়া মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার
ছবি: ইন্সটাগ্রাম