আমাদের গল্পকথার এই চার ভূতসুন্দরীর সঙ্গে কি আপনার কখনো দেখা হয়েছে?
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নিশুতি রাত। ছুটিতে কোনো এক নিরিবিলি রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে আপনি রাতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ মনে হলো কেউ ডাকছে আপনাকে। ঘুম ভেঙে পাশের নাইটলাইটের সুইচটা জ্বালিয়ে বুঝতে পারলেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমেও আপনি ঘেমে নেয়ে উঠেছেন। নিস্তব্ধতার মাঝে ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। দেয়ালঘড়ির বড় কাঁটাটা তিনের ঘর ছুঁয়েছে। কী মনে করে উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল আপনার। সামনের বাগানে অস্পষ্ট এক সাদা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আরো একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে হাতপা অবশ হয়ে আসে। আপনাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে দীঘল কেশের শুভ্রবসনা এক নারী।

অস্পষ্ট এক সাদা অবয়ব দেখা যাচ্ছে
অস্পষ্ট এক সাদা অবয়ব দেখা যাচ্ছে

স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই দীর্ঘাঙ্গী মনে হচ্ছে তাকে। চোখ দুটো কেমন জ্বলছে। বুঝিবা আপনাকে দেখে অদ্ভূতভাবে হেসে উঠছে সে। কিন্তু আপনার নাম জানল কোথা থেকে এই মেয়ে? এত কিছু ভেবে বের করার আগেই কী এক অমোঘ আকর্ষণে আপনি রাতপোশাকে খালি পায়েই বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। করিডোর বেয়ে সিঁড়ির কাছে এসে আবার দেখা পেলেন সেই সাদা শাড়ির মেয়েটির।

সিঁড়ির কাছে এসে আবার দেখা পেলেন সেই সাদা শাড়ির মেয়েটির
সিঁড়ির কাছে এসে আবার দেখা পেলেন সেই সাদা শাড়ির মেয়েটির

কোনোভাবেই যেন তার ডাক উপেক্ষা করতে পারছেন না আপনি। এরপর আপনার আর কিছুই মনে নেই। চোখ মেলে দেখেন রিসোর্টের কেয়ারটেকার আপনার চোখেমুখে পানির ছিটা দিচ্ছেন। আশেপাশে আরো অনেকে। জানতে পারলেন, আপনাকে এই ভোরবেলা পাওয়া গেছে রিসোর্টের সামনের বাগানে। অবাক হয়ে উঠে বসে চারিদিকে তাকিয়ে কোথাও সেই মেয়েটির নামনিশানাও দেখতে পেলেন না। ঢাকায় ফিরে এলেন সেদিনই। এখনও গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে সেই রাতের কথা মনে করে কুলকুল করে ঘামতে থাকেন আপনি। এমন বা এর কাছাকাছি অনেক অভিজ্ঞতার গল্প কিন্তু আমরা প্রায়ই শুনে থাকি অনেকের কাছে। সত্যমিথ্যা আর যুক্তিতর্কের প্রসঙ্গ বাদ দিলে এই ভৌতিক ফ্যান্টাসি, গল্প বা অতিপ্রাকৃত সব কাহিনী কিন্তু সবাই শুনতে ও বলতে ভালোবাসি আমরা। বিশেষ করে শীত আসি আসি ভাব থাকে যখন, এমন হেমন্তের রাতগুলোতে ভূতের গল্পের আসর জমে ভালো।

বিজ্ঞাপন

বছরের এই সময়টায় যেন সাঁঝ পেরোলেই বাতাসে একটা ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত আমেজ পাওয়া যায়। একদিকে আগামীকাল ৩১ অক্টোবর পাশ্চাত্যের হ্যালোউইন উৎসব। আবার ভূগোলকের এইদিকে যুগে যুগে পালিত ভূতচতুর্দশী পড়েছে আজই। এখানেই শেষ নয়। সামনেই ২ নভেম্বরে আছে মেক্সিকোর ফেস্টিভ্যাল অব দ্য ডেড আর খ্রিষ্টিয় ধর্মাবলম্বীদের অল সোলস ডে। সব মিলিয়ে পুরো ভূত ভূত ভাব চারদিকে। আসলে ভূত নয়, আমাদের ছেড়ে যাওয়া সব আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ হয় এমন সব উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিশ্বাস অনুযায়ী।

আমাদের ভূতের গল্পে তেনারা থাকবেনই
আমাদের ভূতের গল্পে তেনারা থাকবেনই

ভূতের গল্প বলা ও শোনার আসর কিন্তু নিজেই একটা উৎসব। বন্ধুরা মিলে হোক, বা পাড়ার অথবা পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্যটিকে ঘিরে আলো আঁধারিতে বসে ভূতের গল্প শোনার মজাই আলাদা। সে গল্প শুনে রাতের ঘুম যে উড়ে যাবে, সে চিন্তা পরে করা যাবে। এসব ভূতের গল্পের অনেকগুলোই কিন্তু মূলত মুখে মুখে ফেরা। আমাদের চিরচেনা ঠাকুরমার ঝুলির কথাই ধরা যাক। সেখানে বর্ণিত শাকচুন্নী আর পেত্নীর কথা কে না জানে। এদিকে এমন গল্পকথায় আরো আছে ভয়ংকর সব জাদুটোনায় পারদর্শী ডাকিনী বা ডাইনির কথা। আর নিশির ডাকের লিজেন্ড মনে হয় এলাকা নির্বিশেষে সব জায়গাতেই প্রচলিত।

বিজ্ঞাপন

এইত কদিন আগেও বিশেষ করে গ্রামবাংলায় রাতের বেলা মাছ ধরা, মাছ কিনে বাড়ি ফেরা বা রান্না করা ও ভাজা মাছ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বেশ সতর্ক হতেন গুরুজনেরা। বিশেষ করে ইলিশ ; অবশ্য জাতীয় মাছের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় ভূতও হয়ত পিঠটান দিয়েছে। যাহোক মাছ সঙ্গে থাকলে দেওয়া হতো রসুন আর শুকনা মরিচ। পুড়িয়ে নেওয়া লোহাও সঙ্গে রাখা হতো।

ভাজা মাছ পেত্নী এসে খেয়ে গিয়েছে
ভাজা মাছ পেত্নী এসে খেয়ে গিয়েছে

তারপরেও 'ভাতের মাড় ঝরাতে ঝরাতে এসে দেখি ভাজা মাছ পেত্নী এসে খেয়ে গিয়েছে' এমন গল্প প্রায়ই শুনতে পেতাম আমরা আগে। এখন বিজলি বাতির ঝলমলে আলোয় ভূত পালিয়েছে। তবে রাত করে মাছ ধরতে গিয়ে ফেরার সময় পেত্নীর নাকিসুরে ডাকাডাকি করা বা শাকচুন্নী পিছু নেওয়ার গল্প এখনো মুখে মুখে ফেরে।

শেওড়াগাছে দেখা মিলতে পারে তাদের
শেওড়াগাছে দেখা মিলতে পারে তাদের

আগে তো প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মিলত শেওড়াগাছ। আর এ গল্প তো সবাই জানে যে শেওড়াগাছে পেত্নী, শাকচুন্নীর আনাগোনা। পুরনো বটপাকুড় বা অশ্বথ আর বাঁশঝাড় নিয়েও এমন সব গল্প প্রচলিত। ঢ্যাঙা তালগাছেও ভূত থাকে বলে জানা যায় গল্পকথায়। অন্ধকার রাতে সেসব গাছের নিচে এখনো কেউ যায় না। আবার পুরনো আমলের বাড়িতে নারীভূতের গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। কড়িবর্গা বা মোটা থামের পেছনে আর আদিকালের আয়নায় হঠাৎ ভেসে ওঠে তাদের অবয়ব। অন্তত তেমনই শোনা যায়। মাঝে মাঝে চুড়ির শিঞ্জিনি বা নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ পান অনেকেই এমন বাড়িতে এসে। বুঝিবা হাসির আওয়াজও পাওয়া যায়।

হিহি করে নাকিসুরে অট্টহাসির জন্য পেত্নী আর শাকচুন্নী বেশ বিখ্যাত। একটু সুন্দর করে বইয়ের ভাষায় তাদের নাম আবার শঙ্খচূর্ণী ও প্রেতিনী হিসেবে লেখা আছে। এদের তুলনায় বেশ গুরুগম্ভীর বলা চলে ডাইনী বা ডাকিনীকে।

বেশ গুরুগম্ভীর বলা চলে ডাইনী বা ডাকিনীকে
বেশ গুরুগম্ভীর বলা চলে ডাইনী বা ডাকিনীকে

কালোজাদুতে পারদর্শী সে। একবার তার চোখ যার ওপরে পড়েছে তার আর রক্ষে নেই। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বসনে মাঝে মাঝে আপনমনে হাসিতে ফেটে পড়ে ডাইনি।

মাঝে মাঝে আপনমনে হাসিতে ফেটে পড়ে ডাইনি
মাঝে মাঝে আপনমনে হাসিতে ফেটে পড়ে ডাইনি

হয়তো তার ভিকটিমের পরিণতির কথা ভেবে। অনেকেই আবার এই ডাইনিদের শরণাপন্ন হয় কারো অনিষ্ট করতে, কারো ওপর প্রতিশোধ নিতে। তবে শেষ পর্যন্ত নিজেই ডাইনির কোপানলে পড়ে জানটা না হারাতে হয়, সেটাই কথা।

সেই যুগযুগ ধরে আমাদের গল্পকথায় আছে নিশি, প্রেতিনী, ডাকিনী আর শঙ্খচূর্ণীর কথা। বহুকাল আগে থেকেই এই চার ভূতসুন্দরী আমাদের ভয় দেখিয়ে আসছেন।

যুগ যুগ ধরে ভয় দেখাচ্ছেন তেনারা
যুগ যুগ ধরে ভয় দেখাচ্ছেন তেনারা
তাদের প্রতি আমাদের আকর্ষণও কম নয়
তাদের প্রতি আমাদের আকর্ষণও কম নয়

জেনজি প্রজন্ম সেভাবে নানিদাদিদের কাছে ভূতের গল্প শুনতে পায় না।  ভূতের গল্পের বইও তেমন পড়ে না। তবে ইউটিউবের ঠাকুরমার ঝুলি কার্টুন আর সে নিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল সব মিমসের কল্যাণে কিছুটা হলেও চেনে ওরা এই ডাইনি, পেত্নী, নিশি আর শাকচুন্নীকে। বিশেষ করে সবুজ গাত্রবর্ণের শাকচুন্নীর ঘাড় মটকে দেওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল তারা। তারপরেও তাদের সঙ্গে আমাদের গল্পকথার এই কিংবদন্তি নারীভূতদের আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া আসলেই প্রয়োজন। এই ভূতের গল্পগুলো আমাদের সাহিত্যজগতের অমূল্য রত্ন বলা চলে৷
ভূতের গল্প বললেও পুরুষের চেয়ে নারী ভূতরাই থাকেন লাইমলাইটে। তেনাদের নিয়ে গল্প থেকে শুরু করে হালের ক্রেজ হরর ঘরানার সব সুপারহিট বলিউড সিনেমা বানানো হচ্ছে অনেক।

এই ভূতরা জীবদ্দশায় ছিলেন অত্যন্ত রূপসী
এই ভূতরা জীবদ্দশায় ছিলেন অত্যন্ত রূপসী

এই সুন্দরী নারী ভূতদের প্রতি আমাদের আকর্ষণও কিন্তু কম নয়। গল্পকথায় তাঁদের ভৌতিক আর ভয়ংকর সব কান্ডকারখানার পাশাপাশি রূপের বর্ণনাও কিন্তু আছে। সব জায়গাতেই ধারণা দেওয়া হয় যে এই ভূতরা জীবদ্দশায় ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। ডাগর চোখ, দীর্ঘ কেশের এই সুন্দরীরা অনেকেই অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। কাউকে হয়তো কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, কেউ নিজেই নিজের জীবন শেষ করেছে। অর্ধেক মানবী তারা, অর্ধেক ভয়ংকর কল্পনা। বলা যায় না, গল্পকথার এই ভূতসুন্দরীদের কারো সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের কোনো এক নিঝুম সন্ধ্যায় বা নিশুতি রাতে।

ফটোগ্রাফি: অনিক মজুমদার

লাইটস: শুভ্রদেব হালদার

রূপ ও কেশসজ্জা: আব্রাহাম আহাম্মেদ অপু

লোকেশন: দোতলা ( ফ্যাশনের সুপরিচিত যৌথ উদ্যোগ)

শঙ্খচূর্ণী ও নিশির শাড়ি: রঙ বাংলাদেশ

গয়না: পোশাক বাই তান্নাস ও চিত্রাঙ্গনা

মডেল: শ্রেয়া, জেসিফার, অরণী, জেরিন

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: দোতলাবাসী

সার্বিক সহযোগিতা: দোতলাবাসীর পক্ষ থেকে ফৌজিয়া আফরিন নিপা

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৬: ০১
বিজ্ঞাপন