মোটামুটি রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম। অনেক পরিবারে মেয়েরা যেভাবে বাবার খুব কাছাকাছি থাকে, আমি কখনোই তেমন ছিলাম না। একটা দূরত্ব থাকত। কিন্তু এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে আমাকে আমার আব্বুর চেয়ে এত ভালো বুঝত। আব্বুর সঙ্গে আমার শারীরিক দূরত্ব ছিল, কিন্তু মানসিকভাবে আমরা ছিলাম খুব কাছে। আমার দুই বড় ভাই আছেন। তাঁরা পড়াশোনা ও খেলাধুলায় সব সময় একদম টপে থাকতেন। অন্যদিকে আমি ছিলাম সব কিছুতেই ‘লেট’। কথা বলা শুরু করা, কোনো কিছু বোঝা—এসব ক্ষেত্রে আমি পিছিয়ে ছিলাম। এ নিয়ে আত্মীয়স্বজন খুব কথা শোনাতেন। কিন্তু আমার আব্বুর আমাকে নিয়ে তেমন কোনো তাড়া ছিল না। আমি যেমন ছিলাম, আব্বু আমাকে সেভাবেই মেনে নেন। আমি খুব আস্তে কথা বলতাম। ঘরে থাকলে কেউ টের পেত না আমি ঘরে আছি। আমার পাশে বসেও কেউ কথা বুঝত না। কিন্তু আব্বুর মাথা নিচু করে ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতে কখনোই অসুবিধা হতো না।
আমার আব্বু লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সেলিম উদ্দিন। আমি জন্মগ্রহণ করার অনেক আগেই অবশ্য তিনি অবসরে চলে যান। আব্বুর বন্ধুদের কাছে শুনেছি, তিনি খুব সৎ ও সাহসী ছিলেন।
ছোটবেলায় আমি এমন ছিলাম যে ক্ষুধা লাগলে কাউকে মুখ ফুটে বলতাম না। আমার মা বুঝতেন না। কিন্তু আব্বু ঠিকই বুঝতেন যে ক্ষুধা লেগেছে। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়েই আমার পুরো ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারতেন। আব্বু ছিলেন এ পৃথিবীতে আমার দোভাষীর মতো। ছোট থাকতে আমি বেশি সময় কাটিয়েছি গাছপালা, পশুপাখির সঙ্গে। আব্বু আমাকে হাতে ধরে ফুল, পাখি ও গাছ চেনাতেন। স্কুলে থাকতে কিশোরী মেয়েদের যে সমস্যা হয়, আমারও তাই হতো। কিন্তু মুখ ফুটে আমি কখনো তা কাউকে বলতে পারতাম না। কিন্তু আব্বু ঠিকই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন,‘ সব কিছু ঠিকঠাক আছে মা?’
আব্বু আমাকে বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। আমি যখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি, তখন তিনি আমাকে ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিম’ বই এনে দিয়েছিলেন। বইটা হাতে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা পড়। এটা পড়ে বোঝ স্বপ্ন কী এবং সেভাবেই স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন নিয়ে মেতে থাক।’
এরপর তিনি আমাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ বইটি কিনে দেন। ওই বয়সে আমি তাঁর আদেশেই বইগুলো পড়ি। তখন কিছুই বুঝিনি। আমার মনে হয়, ওই সময়ে পড়া বই দুটির প্রতিটি লাইন যত বড় হয়েছি, তত আমাকে গাইড করেছে। যেহেতু আমি কথা কম বলতাম, আমার কথাগুলো বোঝানোর জন্য আব্বু চিঠি লেখাতেন। যেমন, আমি ম্যাকগাইভার পছন্দ করতাম। কেন আমি ম্যাকগাইভার পছন্দ করি, সে সম্পর্কে আমাকে লিখতে বলতেন। আমি ভালো লিখতে পারলেই আব্বু আমাকে ম্যাকগাইভার দেখতে দেবেন। যেটা থেকে আমার শেখার কিছু নেই, এমন কিছু তিনি আমাকে দেখতে দিতেন না। আমি আগে ডায়েরি লিখতাম। কিন্তু দেখতাম সেগুলো যে কেউ পড়ে ফেলছে। মানে আমার নিজের বলতে কিছু নেই। আমি আরও কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। তখনই আব্বু আমাকে বলেন, ‘তুমি চিঠি লেখ।’
প্রথম চিঠিটাই আমি আব্বুকে লিখেছিলাম। ক্লাস সেভেনে থাকতে তিনি চেয়েছিলেন আমি ক্যাডেট কলেজে যাই। আমার মনে আছে, আমি তাঁকে লিখেছিলাম, ‘আব্বু, আমি জানি তুমি আমাকে আমার ভালোর জন্যই ওখানে পাঠাতে চাচ্ছ, আমাকে নিয়মানুবর্তী করতে। কারণ, আমি আমার দুই ভাইয়ের মতো চৌকস নই। পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত করতেই আমাকে পাঠাতে চাও। কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার থেকে দূরে থেকে আমার কিছু শেখা হবে বা আমি ভালো থাকতে পারব। আমি তোমার আশপাশে থেকেই শিখতে চাই।’
তিনি আমাকে ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজের জন্য প্রস্তুত করার সময় আমি তাঁকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। চুপচাপ পড়াশোনা শুরু করেছি। এরপর যখন চিঠিটা পেলেন, তখন আমাকে কিছুই বললেন না। আমি কেবল বুঝে গেলাম আমাকে আর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না। এভাবে আমি একটা আশকারা পেয়ে গেলাম। আব্বুর সঙ্গে চিঠি লিখেই কথা বলতাম। এর ফাঁকে ফাঁকে আমি যখন অনেক কষ্ট পেতাম, একা লাগত, তখন আল্লাহকে চিঠি লিখতাম। কোনোভাবে আব্বু এটা বুঝতে পারলেন যে আমি আল্লাহকে চিঠি লিখি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘এটাই তোমার ইবাদত। এটাই তোমার দোয়া। তোমার আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ যেন একেবারে বিচ্ছিন্ন না হয়। সেই যোগাযোগ বা সম্পর্কের মাঝে কাউকে আসতে দেবে না। কারণ, সেটাই তুমি।’ এ কথাটির মর্মার্থ আমি এখনো বুঝিনি। এ নিয়ে আমি তাঁকে অনেক প্রশ্ন করতাম, যেহেতু তিনি একজন সুফি সাধক ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘এই যে তোমার এত প্রশ্ন, এটা করতে করতে একদিন তুমি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করবে, এটাই জীবন। এই পরমের খোঁজটাই জীবন। এটার উত্তর যদি তুমি পেয়ে যাও, তাহলে বুঝতে হবে তোমার খোঁজটা আসলে খোঁজই ছিল না।’
আমি যে এত লাইমলাইটে থাকি, ব্যস্ত থাকি, আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে, ‘আরে নওশাবা আপু, আপনার তো কোনো পরিবর্তনই দেখি না। আগের মতোই আছেন। কেমন বোকাসোকা, আবেগপ্রবণ।’ আমি এত আবেগপ্রবণ ও সহজ আছি বলেই জীবনে অল্পতেই সুখী। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে খুব অল্পের মধ্যে, সাধ্যের মধ্যে জীবন চালিয়ে যেতে পারছি। এত প্রতিকূলতার পরও পারছি। কারণ, আমার আব্বু আমাকে কখনো আমার পরমের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শেখাননি এবং সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছেন। তিনি নিজে জীবনে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন। তাঁর পরমের সঙ্গে যোগাযোগ শক্তিশালী ছিল বলেই আমি কখনো তাঁকে হেরে যেতে দেখিনি। এ জন্য আমাদের পরিবার বা আশপাশের প্রতিবেশী ও পরিচিতজন কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁর কাছেই সাহায্যের জন্য আসতেন। তাঁকে দেখে মনে হতো, খুব স্থির একজন মানুষ। কিন্তু আমি বুঝতাম, কারও কষ্ট বা কারও চোখে পানি দেখলে তিনি ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থির হয়ে যেতেন। সেটা কখনোই বাইরে প্রকাশ পেত না।
আমাকে অনেকে বলে, ‘তুমি এত সংবেদনশীল কেন? তোমার বাবাও কি এমন ছিলেন?’ আমি আমার জীবনের একটি ঘটনা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, সংবেদনশীলতা বর্তমান যুগের জন্য দুর্বলতা, সময়োপযোগী নয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার সংবেদনশীলতা একেবারে বাদ দিয়ে দেব, কিছু থাকবে না। তাহলে আমি পৃথিবীতে ঠিকঠাক থাকব, কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না; অথচ একটা ঘটনা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় অনুভব করেছি, আমি এই সংবেদনশীলতা আমার আব্বুর কাছ থেকে পেয়েছি। পার্থক্য একটাই, তিনি সেটা প্রকাশ না করেই তাঁর কাজ ঠিকভাবে করতেন; কিন্তু আমি অপরিপক্বতার জন্য সংবেদনশীলতা প্রকাশ করতাম। অথচ বুঝেছি, আব্বুর মতো হতে চাইলে এই গুণ পরিহার করা যাবে না; বরং আরও যত্ন নিতে হবে। আমি বুঝতে পারি, সরাসরি না হলেও মৌনভাবে এতে আব্বুর সম্মতি আছে। আমাদের কথা হয় নিঃশব্দে। এখন তিনি শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু আমি জানি তিনি প্রতিনিয়ত আছেন, প্রতিটি নিশ্বাসে আছেন। এ মুহূর্তে আমি যা বলছি, আমি জানি তিনি শুনছেন, তিনি শুনবেন এবং তিনি শুনতে থাকবেন।
আব্বু চাইতেন, আমি প্রফেসর হই। তিনি ভাবতেন, আমি খুব ভালো শিক্ষক হতে পারব। তাই প্রথমে আব্বু আমাকে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি করেন। কিন্তু আমাকে টানছিল চারুকলা। আব্বুকে গিয়ে কথাটা বলি।
তিনি বলেন, ‘তুমি কি জান আমাদের দেশে শিল্পীদের কতটা সংগ্রাম করতে হয়? এরপরও কেন তুমি এখানে পড়তে চাও?’
আমি বলি, ‘আমার মন টানে।’
এটা শোনার পর আব্বু বলেন, ‘তুমি মেরিট লিস্টে এলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
আব্বু ছাড়া আর কেউ আমার সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল না। শুধু চারুকলায় ভর্তি নিয়ে নয়, জীবনে যতবারই আমি কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার পরিবারের সবাই ছিল একপাশে আর আব্বু ছিলেন আমার পাশে।
ছবি: কাজী নওশাবা আহমেদ