পশ্চিমবঙ্গে ঈদের সেকাল-একাল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

‘চাঁদরাত’ কথাটি আমি প্রথম শুনি কলকাতায় আসার পর। অবাঙালি মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকায় কথাটার প্রয়োগ লক্ষ করি। তাঁরা বলতেন ‘চানরাত’। দেখি, ঈদের আগের দিন কীভাবে একটি আস্ত বাজার রাস্তায় নেমে আসে! লোকারণ‍্যের ভিড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের অনেক আগেই থেমে যায় অটো। খালি মানুষ আর মানুষ। শেষ মুহূর্তের বাজার। লাচ্ছা সেমাই, শুকনা সেমাই, বড় বড় ‘খাসি’ টাইপের দেশি মোরগ, আদা, রসুন, গেঞ্জি, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, ইসলামি টুপি, কাচের চুড়ি, পুঁতির গয়না, জুতা, গোলাপ, রজনীগন্ধার তোড়া—সব পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে। মোরগ জবাই হচ্ছে রাস্তার ওপরই। বিরিয়ানি বা চাপের জন্য বড় বড় টুকরা কাটা হচ্ছে। রক্ত ছিটকে গিয়ে রজনীগন্ধার সাদা পাপড়িতে লাগছে। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

প্রতীকি ছবি
প্রতীকি ছবি
ছবি: উইকিপিডিয়া

ফুল বিক্রেতা হাঁক পাড়ছেন, ‘মাত্র ৩০ টাকা ডজন... নিয়ে যান, লে যাইয়ে’। ক্রেতাদের হট্টগোলে চাপা পড়ে যাচ্ছে ফুলওয়ালার হাঁক। ২০০ টাকার টি-শার্ট দর–কষাকষির জেরে রাত তিনটার সময় ৫০ টাকা হবে। রাত থেকে ভোর অব্দি চলবে এই বেচাকেনা। বিক্রেতা এবং খদ্দের কারও কোনো ক্লান্তি নেই। ক্রেতারা এই চাঁদরাতে সবকিছু সস্তায় কিনে খুব লাভবান হতে চান। আর বিক্রেতারা সব ঝেড়ে–মুছে বিক্রি করে দিয়ে মজুত খালি করতে চান।

বিজ্ঞাপন

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে শেষ রোজার ইফতারের পরপরই চাঁদরাতে রাস্তাজুড়ে যেসব দোকান বসে যায়, কারা বসায় এসব অস্থায়ী দোকান? স্থানীয় স্থায়ী দোকানদারেরাই বসান। নিজেরা বসেন না। কিছু চেনা মানুষকে দিয়ে এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবসাটা চালিয়ে নেন। ছুটকোছাটকা কিছু ছোট দোকানদারও ফাঁকতালে বাচ্চাদের জামা, হেয়ারব্যান্ড, বিরিয়ানির মসলা, আতপ চাল, নারিকেল, কাজু, কিশমিশ বিক্রি করতে বসে পড়েন। চাঁদরাতের মুখ্য ভূমিকা যার, সেই চাঁদকে দেখতে কজন মানুষ ছাদে ভিড় জমান কে জানে! সব বাড়ির মানুষ তখন রাস্তায়।

এখন ঈদ উপলক্ষে ঘরে ঘরে লাল–নীল টুনি বাল্ব জ্বলে। এত কৃত্রিম আলোর বন্যায় ঈদের ক্ষীণ চাঁদ মর্মাহত হয়ে মেঘের আড়ালে মুখ লুকায় কি না, জানা নেই! এখন তো মুঠোফোনেই জানা যায় আরব দেশে ঈদ পালিত হওয়ার খবর। ব্যস! পরদিন আমাদের ঈদ নিশ্চিত। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’...বাংলাদেশের রেডিও চ্যানেলে চাঁদরাতে এই নজরুলগীতি কি এখনো বাজে? এই গান ছাড়া ঈদের কথা ভাবাই যায় না।

বিজ্ঞাপন

আমার কিশোরীবেলায়ও হাটে–বাজারে এত সেমাই বিক্রি হতে দেখিনি। ঈদকে কেন্দ্র করে এখন সেমাইয়ের একাধিক দোকান দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। ঘিয়ে ভাজা সেমাই, ঝাঁটার কাঠির মতো এই লম্বা লম্বা সেমাই, সাদা সেমাই, রং দেওয়া হলুদ সেমাই। সেমাইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে যেতে হয়—কোনটা নেব! কোনটা বেশি ভালো!

প্রায় প্রতিটা মুসলিম বাড়িতেই সেমাই বানানোর একটি পিতলের কল থাকত
প্রায় প্রতিটা মুসলিম বাড়িতেই সেমাই বানানোর একটি পিতলের কল থাকত
ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলার কথা মনে আছে। তখন প্রায় প্রতিটা মুসলিম বাড়িতেই সেমাই বানানোর একটি পিতলের কল থাকত। তার একটা মুখ দিয়ে ময়দার তাল ঢুকিয়ে হ্যান্ডেলটা ঘোরালে আরেকটা মুখ দিয়ে ময়দা অনেকটা চাউমিনের মতো দেখতে হয়ে বেরোত। ওগুলো শুকিয়ে কৌটায় ভরা হতো। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে সেমাই বানানোর কল হারিয়ে গেছে। এসে গেছে নানান কোম্পানির প্যাকেটজাত রেডিমেড সিমুই, সামাই বা সেমাই। কবে থেকে যে ‘সিমুই’ হলো জানি না!

ঈদের আগের দিন আমার মেজ মামা লম্বা একটি দড়ি নিয়ে হাজির হতেন। সেই দড়িতে বিভিন্ন জায়গায় অজস্র গিঁট বাধা থাকত। বাড়ির ছোট সদস্যদের জামার মাপ থাকত ওই একটাই দড়িতে। লম্বায় আমার মাপ নিয়ে দড়িটায় শেষ গিঁটটা পড়ত। সবাইকে মনে রেখে ওই দড়ির মাপ দিয়ে মেজ মামা কী করে যে সবার ঠিকঠাক মাপের জামা বা ফ্রক কিনে আনতেন... সেটা আমার কাছে এখনো বিস্ময়ের। তখন বাজারে গুঁড়া মেহেদির অতটা চল ছিল না। মেহেদিগাছের টাটকা পাতা সংগ্রহ করা হতো। তারপর পাতাগুলো শিল–পাটায় বেটে হাতে-পায়ে নানা রকম নকশা আঁকা হতো। কে কতক্ষণ মেহেদি লাগিয়ে রেখে বেশি রং আনতে পারবে, সে ব্যাপারে বোনদের মধ্যে একটা চোরা প্রতিযোগিতা চলত। কেউ কেউ হাতের ফুল–পাতা নকশার ফাঁকে কায়দা করে নিজের পছন্দের মানুষের নামের আদ্যক্ষর লিখত।

কে কতক্ষণ মেহেদি লাগিয়ে রেখে বেশি রং আনতে পারবে, সে ব্যাপারে বোনদের মধ্যে একটা চোরা প্রতিযোগিতা চলত
কে কতক্ষণ মেহেদি লাগিয়ে রেখে বেশি রং আনতে পারবে, সে ব্যাপারে বোনদের মধ্যে একটা চোরা প্রতিযোগিতা চলত
ছবি: ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল

ওদিকে আতপ চালের ক্ষীরের সুঘ্রাণে ছাপোষা রান্নাঘরের ছাদে জিন-পরিরা নেমে আসত একে একে। পায়েস নয়; কোরানো নারকেল, চিনি বা গুড় দিয়ে আতপ চালের ক্ষীর। দুধ দিয়ে সেমাই। এ ছাড়া ঘিয়ে সেমাই ভেজে তারপর সেটাকে চিনি দিয়ে শুকনা করে বানানো হয় অসাধারণ এক মিষ্টান্ন। সেমাই বা ক্ষীরে বাদাম, কিশমিশ কিচ্ছু থাকত না। আজকের দিনে বিভিন্ন রকম বাদামসহযোগে বানানো সেমাইয়ে সেই অতুলনীয় স্বাদ আর পাই না। ঈদের আগের রাত থেকেই বানানো হতো আতপ চালের সাদা তুলতুলে রুটি। রুলময়দার পরোটা। দেশি মুরগির ঝোল। খাসির মাংস কষা। কোনো মাংসেই আলু দেওয়া হতো না। আলুবিহীন মাংসই ছিল ঈদের বিশেষ পদ। ঈদের দিন সাদা ভাত এবং পোলাও রান্না করা হতো। সব মুসলিম বাড়িতেই ভালোমন্দ রান্না হতো।

অভাবি মানুষের বাড়িতে আন্তরিকভাবে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল। সেদিন ভিখারিদের পয়সাকড়ি দেওয়া হতো না। সব্বাইকে রুটি, পরোটা, মাংস, ক্ষীর, সেমাই দেওয়া হতো। ভিখারিরা দোয়া করতে করতে খুশি মনে বিদায় নিত।
আজ প্রতিটি পাড়ায়, প্রতিটি গলির মুখে বিরিয়ানি–চাপের দোকান। সুইগি আর জোমাটোর মতো ফুড ডেলিভারি সার্ভিস চলছে রোজ দিনরাত। সরবরাহ করে যাচ্ছে কত মনপসন্দ লোভনীয় দামি খাবার! কাবাব, বিরিয়ানি, পোলাও—আমরা অহরহ খাচ্ছি যেকোনো উপলক্ষে বা কোনো উপলক্ষ ছাড়াই। তাই ঈদ উপলক্ষে আলাদা করে ভালোমন্দ রান্না করা এবং খাওয়ার আগ্রহ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ভোগবাদ এসে আমাদের ছোট ছোট অথচ অমূল্য আনন্দগুলোকে কবে যে গ্রাস করে নিয়েছে, বুঝতেই পারিনি!

এখনো কাচের চুড়ি একই রকমভাবে বিক্রি হয়
এখনো কাচের চুড়ি একই রকমভাবে বিক্রি হয়
ছবি: সংগৃহীত

তবে এখনো কাচের চুড়ি একই রকমভাবে বিক্রি হয়, সেই অতীতের মতোই। কত রকম রং আর কত রকম নকশা! কুড়ি টাকা ডজন। চাঁদরাতে চন্দ্রমুখী সুন্দরীরা চুড়ির দোকানে ভিড় জমান। যুবা বয়সী চুড়ি বিক্রেতা সুন্দরীদের হাতের মাপ বুঝে চুড়ি পরিয়ে দেন কোমল হাতে। তা নিয়ে সখীদের মধ্যে কানে কানে কথা আর বিস্তর হাসাহাসি চলে। চুড়িওয়ালার লজ্জা পাওয়া মুখে লালচে আভা—এই চিত্র চিরন্তন। এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। চালের আটার রুটি, কষানো মাংস, ক্ষীর, সেমাই, আনন্দ, বন্ধুদের কাছে পাওয়া, নানা রকম খাবার নিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, কাচের চুড়ি, মেহেদি পরা হাত, কস্তুরি আতরের গন্ধ, ঈদগাহের সেই গমগমে ব্যাপারস্যাপার, সাদা পাঞ্জাবিতে প্রিয় মুখ, পয়সার বদলে একগাদা ভালোমন্দ খাবার নিয়ে হাসিমুখে দরিদ্র মানুষদের দোয়া ‘আল্লাপাক তোমাকে সহিসালামত রাখুক’—এগুলোই ঈদের আলোকিত দিক। আমার সব বন্ধুকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাই।
ঈদ মোবারক!

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২২, ১৩: ১০
বিজ্ঞাপন