বাবার হাতের আঙুল আঁকড়ে টলোমলো পায়ে সেই যে হাঁটতে শেখা। বাবার চওড়া কাঁধের ছায়ায় নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠা। বাবা আমাদের পরম আশ্রয়। তিনি পাশে থাকলে যেন শ্বাপদসংকুল পৃথিবীটাও অভয়ারণ্য হয়ে যায়। বাবা আমাদের জীবনের প্রথম মহানায়ক, আমাদের সবার সুপারহিরো।
তারপর বড় হয়ে যখন একটু একটু করে না চাইলেও বাবার সঙ্গে কোথায় কী এক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। জীবনযুদ্ধ যুঝতে যুঝতে কোনো এক সন্ধ্যায় হয়তো ব্যস্ত রাস্তা পার হতে গিয়ে আবার বাবার হাতের আঙুল ধরতে ইচ্ছা হয় খুব। কালের ভারে নুয়ে পড়া বাবাও কি মনে মনে হাত বাড়িয়ে আমাকেই খুঁজছেন তাঁর আঙুল আঁকড়ে ধরব বলে? বড় হলে কেন যে বাবারা দূরে সরে যান!
‘বাবা বলে গেল, আর কোনো দিন গান কোরো না।/ কেন বলে গেল, সেই কথাটি বলে গেল না।' বাবার সঙ্গে এমন অনেক না-বলা কথা, বাবার কাছে অনেক না-করা প্রশ্ন রয়েই যায় সারা জীবন ধরে। যে প্রজন্মটি এখন প্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবি করতে পারে নিজেকে, তাদের অনেকের বেলায়ই ব্যাপারটি সত্য। চিরাচরিত কী এক অলিখিত নিয়মে বাবারা অনেকেই যেন কেমন একটু শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়, সংকোচ আর রাশভারী মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন তাঁদের অপত্য স্নেহের অমৃত ফল্গুধারা। ছেলেমেয়ে বড় হতে থাকলে অনেক বাবা যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়েন নিজের আদর-স্নেহ সন্তানের সামনে মন খুলে মেলে ধরতে।
আবার এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বাবা একেবারে বন্ধুর মতো ছেলেমেয়ের পাশে থাকেন। তাদের ছেলেমানুষি আবদার, কৈশোরের জেদ-রাগ, তারুণ্যের উচ্ছলতা— সবকিছুর সঙ্গী হন তিনি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই বন্ধু-বাবার খুব বেশি প্রয়োজন শিশু, কিশোর আর তরুণ সন্তানদের জন্য। এই বাবা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেন, সাইকেল চালান। মেয়ের চুলের বিনুনি বেঁধে দেন। ছেলেকে বয়ঃসন্ধিকালের সকল বিষয় খুলে বলেন। এই বাবার বন্ধুত্ব ছেলেমেয়েদের মাদক বা পর্নো আসক্তি থেকে বাঁচায়। তাঁর কাছে নিঃসংকোচে কিশোরী মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজনীয়তা জানায়। এই বাবার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ছেলেমেয়েরা ইভ টিজিং আর সাইবার বুলিইং মোকাবিলা করে অপার সাহসিকতায়। এই বন্ধু-বাবারাই গড়তে পারেন লাখো সুনাগরিক আর ভালো মানুষ। রুখে দিতে পারেন মূল্যবোধের জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকা অবক্ষয়।
বাবার আত্মত্যাগ, অবিরাম স্নেহ-শাসন—এই সবকিছুর কোনো তুলনা নেই পৃথিবীতে। সন্তানের নিশ্চিন্ত বর্তমান আর সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন তাঁরা। নিজে খেয়ে না–খেয়ে, রিপু বা সেলাই করা কাপড় আর সুকতলি মেরামত করা জুতা পায়ে দিয়ে কাটিয়ে দেন জীবন—এমন কত যে বাবা আছেন আমাদের দেশে! বাবা দিবসের এই দিনটিতে আরেকটু বেশি করে বাবাদের পাওয়া-না পাওয়াগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
সন্তানেরা শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে একসময় বড় হয়ে যায়। তাদের নিজেদের জগৎ তৈরি হয়, নিজেরাই বাবা-মা হয় তারা। এই ফাঁকে তাদের বাবাদের বয়স যায় বেড়ে। ঠিক সেই কঠিন সময়ে তাঁদের শরীর ও মনে এক বিশাল ভাটা নিয়ে আসে বার্ধক্য। আগের মতো পাহাড় ঠেলে সংসারের সব দায়িত্ব, সব চাহিদা মেটানো যায় না। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বয়সের ভারে আর দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শরীরে দানা বাঁধে জরা ও বিভিন্ন রোগব্যাধি।
এই সময়ে বাবাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সন্তানদের সঙ্গে ভৌগোলিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব। দূরদেশে পাড়ি জমায় সন্তানেরা, বাকিরা একই ছাদের নিচে থেকেও যেন আলাদা জগতের বাসিন্দা৷ বাবার হাতের সতৃষ্ণ আঙুলগুলো কিন্তু আগের মতোই ছোট ছোট হাতের মুঠিগুলো খুঁজে বেড়ায়। হাঁটতে গিয়ে পা টলে উঠলে, সিঁড়ি বাইতে হাঁপ ধরলে অথবা এমনিতেই কোনো একলা বিকেলে তাঁর হাতটি ধরার কেউ থাকে না। অথচ একটু খেয়াল করে এমন সময়গুলোতে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া যায় বাবাকে। শারীরিক, মানসিক আর অর্থনৈতিকভাবে তাঁর হাতে হাত রেখে, আঙুল আঁকড়ে বলা যায়, ‘বাবা, আমি আছি।’
বাবা দিবসে পশ্চিমা সমাজে অনেকেই বাবাকে দামি উপহার, ফুল, চকলেট আর কার্ড পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করেন বলে অনেক সমালোচনা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে পরিবারের বন্ধন সুদৃঢ় হওয়ার পরও অশীতিপর বৃদ্ধ রিকশাচালক আর ফেরিওয়ালা কেন দুমুঠো ভাতের জন্য টেনে চলেন নিজের দুর্বল শরীরটাকে, কেন মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কদাচিৎ দেখা মেলে প্রবাসী সন্তানের? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আজকের বাবা দিবসের চেয়ে ভালো দিন আর নেই।
কত জনের বাবা আজ পরপারে পাড়ি দিয়েছেন, চাইলেও তাঁকে ফিরে পাওয়া যায় না। আজ যেন প্রত্যয় নিই আমরা বাবার ভালোবাসার অকপট স্বীকৃতি দিতে, কিছুটা হলেও প্রতিদান দিতে, যদিও তা কোনো দিন সম্ভব নয়। তবুও নিজের সকল দ্বিধা আর সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে আজ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলি, ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই।’