কেক, ডেজার্ট-পেস্ট্রি আর পনিরের দেশ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অপার্থিব না হলেও অবলীলায় ‘বিস্ময়কর’ বলা যায় যে খাবারকে, সেটি হলো ‘দুধ’। উজ্জ্বল সাদা রঙের এই তরল খাদ্য সাধারণভাবে সুপাচ্য ও অত্যন্ত পুষ্টিকর। দুধবিহীন পৃথিবী কল্পনা করা যায় না। কেউ তা করেও না। বিশেষ করে ফরাসিরা। কারণ, পারফিউমের দেশ ফ্রান্স যে শুধু সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, ফ্যাশন, রুচি, বিলাস আর রোমান্টসিজমে ভরপুর, তা কিন্তু নয়। রন্ধনশিল্পে কৌলীন্য এ দেশটির এক ঈর্ষণীয় অর্জন, এক অনন্য ঐতিহ্য। এর মধ্যে আবার ফরাসিরা এক ধাপ এগিয়ে আছে কেক, ডেজার্ট-পেস্ট্রি আর পনির তৈরিতে। চমৎকার স্বাদ, মনমাতানো ঘ্রাণ আর সেই সঙ্গে চোখজুড়ানো সব কেক, পেস্ট্রি আর পনির ফরাসি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর তাই অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এ দেশে দুধের খুব বেশি সমাদর।

আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে সেই নব্যপ্রস্তর যুগ, অর্থাৎ যখন থেকে মানুষ চাষাবাদ ও পশু পালন শুরু করেছে, তখন থেকেই এ দেশের মানুষ উপাদেয় সব দুগ্ধজাত খাবারের সঙ্গে পরিচিত। তবে সে সময়ে তরল দুধ পান করা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, দুধ সংরক্ষণের কোনো কার্যকর উপায় জানা ছিল না। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ক্ষতিকর অণুজীব দ্রুত দুধে ছড়িয়ে পড়ত। ফলে বিপুল পরিমাণ দুধ নষ্ট হয়ে যেত।

বিজ্ঞাপন

ষড়্‌ভুজ আকৃতিবিশিষ্ট ফ্রান্সের মূলভূমির সীমান্তে আছে সাগর, মহাসাগর আর পর্বতমালা। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়াতে রয়েছে বিস্তীর্ণ চারণভূমি। দুধের খামার স্থাপনের জন্য চমৎকার আবহাওয়া। প্রায় ৭০ হাজার খামারি আছেন এ দেশে। আর প্রতিটি খামারে কম করে হলেও ৫০টি করে উন্নত জাতের গাভি আছে।

দুধ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু সব খাবার
দুধ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু সব খাবার
ছবি: লেখক কতৃক সংগৃহীত

১৮৬৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন পাস্তুরাইজেশন বা পাস্তুরায়ন প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের ফলে দীর্ঘ সময় ধরে দুধ সংরক্ষণ সম্ভব হয়। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দুগ্ধজাত পণ্য বা ডেইরি প্রোডাক্ট শিল্প প্রাণ পায়। শুরু হয় গৌরবময় অধ্যায়। শৈল্পিক সুষমায় উদ্ভাসিত হয় দুধনির্ভর কেক, পেস্ট্রি-মিষ্টান্নের মনমাতানো জগৎ। সে জগতের অনেকটাই বহুকাল ধরে নিজেদের দখলে রেখেছে ফরাসিরা।

বিজ্ঞাপন

ফরাসিরা ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস পনির খেতে খুব ভালোবাসে। প্রতিবার খাবারের পর তাদের একটুখানি পনির চাই-ই চাই, সে দুপুরে হোক বা রাতে কিংবা সকালের নাশতার সঙ্গে। তা ছাড়া নানা পদের স্যুপ, রান্নায় নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে পনিরের ব্যবহার অনেকটাই ফরাসি রন্ধনশিল্পের কৌলীন্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। ফ্রান্সের জনপ্রিয় পনিরগুলোর অন্যতম হচ্ছে ক্যামোমবার্ত, এম্মেতাল, কমতে, ব্রি, কান্তাল, মিমোলেত, রকফোর্ত ইত্যাদি। তারা উৎসব, অনুষ্ঠানে বা খাবারের পরে খুব মজা করে ডেজার্ট ও দই খেয়ে থাকে। যারা ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছেন, তাঁরা হাজার রকম কেক, ডেজার্টের সমারোহ দেখেছেন। এর মধ্যে আছে ক্রেম ব্রুলে, মিল-ফাই, ম্যাকারন, মুছ, ম্যাকরন, সুফলে, ক্রেপ, এক্লেয়ার, আরও কত কী! নানা নামের, নানা খাবার, প্রতিটিই স্বাদে আলাদা আর খুবই অসাধারণ। সব কটিতেই দুধ আছে।

ফ্রান্সের শেফরা তাঁদের কেক, ডেজার্ট-পেস্ট্রি, দই, পনির ও মাখন তৈরিতে দুধের ব্যবহারে বেশ খুঁতখুঁতে। স্বাদ, ঘ্রাণ, গঠন, গুণ ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গাভি ও মোষের দুধ বেছে নেয়া হয়। ননিযুক্ত, ননিমুক্ত, আধা ননিযুক্ত, ঘন দুধ, গুঁড়া দুধ, ল্যাকটোজ (দুধের চিনি) মুক্ত, সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুযায়ী ইত্যাদি অনেক ভাগে বা শ্রেণিতে দুধকে ভাগ করা যায়। ফরাসিরা আবার পাহাড়ে আর সাগরের তীরে চরে বেড়ানো গাভি ও মোষের দুধে পার্থক্য করতে পারে। তাদের মতে, পাহাড়ে বন্য লতাপাতা-ফুল খাওয়া গাভি, মোষের দুধের আলাদা ঘ্রাণ ও স্বাদ থাকে। ফ্রান্সের উত্তরে সাগরের তীরে চরে বেড়ানো গাভি ও মোষের খাবারে লবণ ও শৈবালের আধিক্য থাকে বলে দুধের স্বাদ ও ঘ্রাণ আলাদা হয়। অর্থাৎ এ প্রাণীগুলোর খাদ্য এবং সেই সঙ্গে তাদের জাতের দিকে খেয়াল রাখা হয়। আর মাখন তৈরিতেও অনেক রকম কায়দা–কৌশল প্রয়োগ করা হয়। মিহি, অতিমিহি, লবণাক্ত, লবণবিহীন, আধা লবণাক্ত, নরম, তরল, ফাঁপানো ইত্যাদি অনেক রকমের মাখন তৈরি হয় এখানে।

ফ্রান্সে দুধ ও মাংস উৎপাদনকারী পশুকে অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষম করার জন্য কোনো রাসায়নিক ও হরমোন ব্যবহার করার ব্যাপারে কঠোর আইন রয়েছে। তা ছাড়া চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেও অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে, যেগুলো মেনে চলতেই হবে। পশুর খাবারের মানের ব্যাপারেও শিথিলতা নেই। বিশেষ করে গরু যে বায়ু ত্যাগ করে, তাতে মিথেন গ্যাস থাকে। কানাডা ও অন্যান্য আরও কিছু দেশে এমন গ্যাসদূষণ কমানোর জন্য গরুর খাবারে একধরনের অ্যাডিটিভ মেশানো হয়। তাতে গরুর দুধে তৈরি মাখনের স্বাদ কমে যায়।

ম্যাকারনের পেস্ট্রি, খেতে যেমন স্বাদ, দেখতেও তেমন সুন্দর।
ম্যাকারনের পেস্ট্রি, খেতে যেমন স্বাদ, দেখতেও তেমন সুন্দর।
ছবি: আন্তর্জাতিক পেস্ট্রি মেলা ২০২১-এর ছবি লেখক কতৃক সংগৃহীত

ফ্রান্সের শেফরা তাই গরুর খাবারে এমন অ্যাডিটিভ মেশানো মোটেই পছন্দ করেন না। এদিকে তরল দুধ বাজারজাত করতে যে কাগজ বা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ব্যবহার করা হয়, তা মোটেই পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে বেশ কয়েকটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান দুধের ক্যাজিন (একধরনের প্রোটিন) থেকে দুধের প্যাকেট তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। অচিরেই বাজারে এমন পরিবেশবান্ধব মোড়কে দুধ পাওয়া যাবে। তখন সালাদের সঙ্গে মিশিয়ে বা প্যাকেটসহ দুধ জ্বাল দিয়ে খেয়ে ফেলা যাবে।

১৯৮৯ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পর পর ফ্রান্সের লিওঁ শহরে ‘বিশ্বের সেরা পেস্ট্রি শেফ’ শিরোপার আয়োজন করা হয়। এই মহাযজ্ঞে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নামকরা সব শেফ অনেক উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকেন। সে প্রতিযোগিতায় জাপান, ইতালি, বেলজিয়াম, মিসরের সদর্প উপস্থিতি থাকলেও ফরাসিরাই বেশির ভাগ স্বর্ণপদক অর্জন করে। ২০১৯ সালে পুরুষদের একচেটিয়া শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করে প্রথবারের মতো বিশ্বের সেরা পেস্ট্রি শেফ নির্বাচিত হয়েছেন একজন ফরাসি নারী, জেসিকা প্রেয়ালপাতো।

২০১৯-এ ‘বিশ্বের সেরা পেস্ট্রি শেফ’ নির্বাচিত হয়েছেন একজন ফরাসি নারী, জেসিকা প্রেয়ালপাতো।
২০১৯-এ ‘বিশ্বের সেরা পেস্ট্রি শেফ’ নির্বাচিত হয়েছেন একজন ফরাসি নারী, জেসিকা প্রেয়ালপাতো।
ছবি: লেখক কতৃক সংগৃহীত
জেসিকা প্রেয়ালপাতোর অপূর্ব সৃষ্টি
জেসিকা প্রেয়ালপাতোর অপূর্ব সৃষ্টি
ছবি: লেখক কতৃক সংগৃহীত

ইতিহাসের প্রথম তারকা খ্যাতিসম্পন্ন ডেজার্ট শেফ মারি আঁতোয়ান কারেম এ দেশেই জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দুধ, চকলেট ও মাখন ব্যবহার করে ফরাসিদের মিষ্টান্ন পৌঁছে দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। তাঁর দেখানো পথ ধরে আজকের মেধাবী শেফরা দুধ নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন একান্ত নিষ্ঠায়। বিজ্ঞান ও শিল্পের সমন্বয়ে পৃথিবী চমকে দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে খাবারের টেবিলে পরিবেশিত হচ্ছে ‘মলিকুলার গ্যাস্ট্রোনমি’র মূলনীতিতে তৈরি অসাধারণ সব খাবার। আর এসব খাবারের অনেকটাই দখল করে আছে অতিবিস্ময়কর সাদা রঙের তরল এই দুধ।

বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে একটাই চাওয়া—পৃথিবীর সব মানুষ থাকুক দুধে-ভাতে।

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন