রমজান মাস এলেই সবার মুখে মুখে প্রায়ই একটি প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়তো পাড়ার চায়ের আড্ডায়ও এ নিয়ে চলতে থাকে তুমুল বিতণ্ডা। সেটি হলো চিকন নাকি মোটা জিলাপি?
দল যেদিকেই ভারী হোক না কেন, প্রসঙ্গ যখন জিলাপিকে কেন্দ্র করে, তখন তার মধ্যে একটি বিষয় থাকবেই। আর তা হলো জিলাপির ‘প্যাঁচ’। আবার এদিকে রসে পরিপূর্ণ, স্বাদে-গন্ধে মনমাতানো এই মিষ্টান্নের ইতিহাসটাও একটু প্যাঁচানোই বটে! এ বলে এ কথা তো ও বলে সে কথা। কোনো দিকেই পক্ষপাতিত্ব না রেখে বরং চলুন জেনে নেওয়া যাক জিলাপির এই ঐতিহাসিক প্যাঁচের সব গল্প।
জিলাপির উৎপত্তিটা আসলে কোথায়, তার নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো অব্দি পাওয়া যায়নি। তবে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, জিলাপির সবচেয়ে পুরোনো লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায়, মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদির লিখিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রান্নার বইয়ে।
আবার ইতিহাসে আছে, এর আগেই জিলাপির আবিষ্কার করে মিসরের ইহুদি সম্প্রদায়। ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব ‘হানুক্কাহ’ পালনে তৈরি করা হতো একধরনের প্যাঁচানো মিষ্টান্ন। তারা এই মিষ্টান্নের নাম দিয়েছিল ‘জালাবিয়া’। ধরা যেতে পারে, মূলত এই ‘জালাবিয়া’ ছিল জিলাপির প্রাচীনতম নাম ও রূপ।
কালক্রমে জিলাপি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। জানা যায়, মোগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টান্নগুলোর একটি ছিল জিলাপি। জিলাপির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তিনি এই মিষ্টির নাম রেখেছিলেন নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘জাহাঙ্গীরা’। অর্থাৎ জিলাপির ইতিহাস খানিকটা রাজকীয়ও বটে!
ইরানে এই মিষ্টান্নের নাম ‘জেলেবিয়া’। সে দেশ রমজান মাসে এই মিষ্টান্ন তৈরি করে দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তুরস্ক, লেবানন এমনকি গ্রিসেও এই প্যাঁচদার মিষ্টান্নটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিদ্যমান এবং বেশ জনপ্রিয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপির প্রবেশ মূলত মুসলিম বণিকদের মাধ্যমেই ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্ভবত পারসি ও তুর্কিদের প্রভাবেই খাদ্যটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে। আবার এদিকে আরেক সূত্রে জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতে জিলাপির মতো এক মিষ্টান্নকে বলা হতো ‘কুন্ডলিকা’। সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘গুন্যগুনবোধিনী’তে জিলাপি তৈরির জন্য যে উপাদানের তালিকা পাওয়া, তার সঙ্গে আধুনিক জিলাপি তৈরির প্রক্রিয়ার মিল রয়েছে। আর এই গ্রন্থের সময়কাল ছিল ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ!
জিলাপির প্যাঁচ খোলার প্রচেষ্টা শেষে বোঝাই যাচ্ছে, ভারতবর্ষে কিংবা গোটা পৃথিবীতেই জিলাপি নতুন কোনো মিষ্টান্ন নয়। নামে ভিন্ন হলেও উপকরণ, আকার–আকৃতি ও স্বাদে জিলাপি স্বরূপে বিরাজ করছে ইতিহাসের পাতা, মানচিত্রের অলিগলিতে। আর এই ভবঘুরে স্বভাবের কারণেই বাংলায় পাড়ি জমিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে জিলাপি বা জিলিপি।
আবার এদিকে নাম নিয়ে বিতর্ক শুরু করা হলে তা শেষ হওয়ার নয়। জিলাপি নিয়ে বিতর্ক এমনিতেও কম নয়! ইফতারের মুড়িমাখায় জিলাপি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে বিরোধ যেমন আছে, তেমনি বিরোধ আছে জিলাপির আকার-আকৃতি নিয়েও। তবু এত বিরোধ আর প্যাঁচের পরেও ইফতারের প্লেটে জিলাপি এক অত্যাবশকীয় মিষ্টি সদস্য। তা ছাড়া জিলাপি ছাড়া কি ইফতারি জমে?