মুগ ডালের নামে বিক্রি হওয়া, ভারত থেকে আনা এই মথ ডাল আসলে কী, কতটা ক্ষতিকর
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের দেশে জীবনযাপনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোর একটি হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। এর যেন কোনো শুরুও নেই, শেষও নেই। প্রতিদিন নিত্যনতুন ভয়াবহ সব স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছি আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন পদ্ধতির ভেজালে। আর এই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে ভারত থেকে নিয়ে আসা সস্তা মথ ডাল হলুদ রং করে মুগ ডালের নামে বিক্রি করা। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ) ভোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তাঁরা মুগ ডাল কেনার আগে যাচাই করে নেন। কারণ, বাজারে সস্তা মথ ডালে কৃত্রিম রং দিয়ে রাঙিয়ে মুগ ডাল হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। সম্প্রতি জারি করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিএফএসএ জানিয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী অবৈধ হলুদ রং টারট্রাজিন মথ ডালের সঙ্গে মিশিয়ে সেটিকে মুগ ডালের মতো দেখানোর চেষ্টা করছেন এবং এভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, এই হলুদ রং খাবারে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয় এবং এটি খেলে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

আস্ত মথ ডাল বা মথ বিনস এরকম হয় দেখতে
আস্ত মথ ডাল বা মথ বিনস এরকম হয় দেখতে

আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আমদানি তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বিএফএসএ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে মথ ডালের আমদানির পরিমাণ মুগ ডালের দ্বিগুণ ছিল। তবে বাজারে মথ ডাল নামে কোনো পণ্য বিক্রি হচ্ছে না।

এটি খোসাসহ আস্ত মুগ ডাল
এটি খোসাসহ আস্ত মুগ ডাল
বিএফএসএফ প্রেস বিজ্ঞপ্তির ছবি
বিএফএসএফ প্রেস বিজ্ঞপ্তির ছবি

সংস্থাটির ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাজারে মুগ ডাল হিসেবে বিক্রি হওয়া নমুনার অর্ধেকের বেশি ডালে কৃত্রিম রং মেশানো ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, অননুমোদিত খাদ্য রং ব্যবহার, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, সরবরাহ বা এ ধরনের ভেজাল খাদ্য বিক্রি করা ২০১৩ সালের নিরাপদ খাদ্য আইন-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই এই অসাধু ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে চলেছেন রং করা মথ ডাল।

বিজ্ঞাপন

আসলে নিরীহ এই কম প্রচলিত মথ ডালের কিন্তু নিজের কোনো দোষ নেই। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলে বিনস–জাতীয় এই খাবার বেশ জনপ্রিয়। এর স্বাস্থ্যগুণ জানলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। পাঞ্জাবি ভাষায় মোঠ ডাল বা মাটকি ডাল স্বাভাবিকভাবে বাদামি বা হলদে বাদামি রঙের, আর মুগ ডাল খোসাসহ সবুজ, ভেতরে উজ্জ্বল হলুদ। সাধারণত আমাদের দেশে খোসা ছাড়ানো হলুদ মুগ ডাল বিক্রি করা হয়। এখন এই মথ ডালকে মুগ ডালের মতো দেখানোর একমাত্র উপায় হলো কৃত্রিম রং করা।

মথ ডালের গাছ এমন হয়, প্রচুর চাষ হয় পাঞ্জাবে
মথ ডালের গাছ এমন হয়, প্রচুর চাষ হয় পাঞ্জাবে
নানাভাবে রান্না করে খাওয়া যায় এই সুস্বাদু মথ ডাল
নানাভাবে রান্না করে খাওয়া যায় এই সুস্বাদু মথ ডাল

আসুন এবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আলোচনায় উঠে আসা এই মথ ডালের ব্যাপারে কিছু জেনে নিই।

ডাল–জাতীয় এ খাবারে কাঁচা অবস্থায় প্রতি ১০০ গ্রামে থাকে প্রায় ৩৪৩ ক্যালরি, ২৩ গ্রাম প্রোটিন, ৬২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট আর ১ দশমিক ৬ গ্রাম ফ্যাট। তবে এতে এমন কিছু উপাদান থাকে, যেগুলো পুষ্টি শোষণে বাধা দেয়। তাই পরামর্শ দেওয়া হয় মথ ডাল কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সম্পূর্ণরূপে রান্না করে খেতে, এতে এর প্রোটিন সহজে হজম হয়।

পুষ্টিকর মথ ডালে কোনো ক্ষতি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না
পুষ্টিকর মথ ডালে কোনো ক্ষতি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না

প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) মথ ডালের পুষ্টিগুণ

শক্তি ১,৪৩৬ কিলোজুল (৩৪৩ ক্যালোরি)

কার্বোহাইড্রেট ৬১.৫ গ্রাম

চর্বি ১.৬ গ্রাম

প্রোটিন ২২.৯ গ্রাম

ভিটামিন বি১ ০.৬ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি২ ০.১ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি৩ ২.৮ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি৫ ০.৫ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি৬ ০.৪ মিলিগ্রাম

ক্যালসিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম

আয়রন ১০.৮ মিলিগ্রাম

ম্যাগনেসিয়াম ৩৮১ মিলিগ্রাম

ফসফরাস ৪৮৯ মিলিগ্রাম

বিজ্ঞাপন

মথ ডালের উপকারিতা

১. হাড় মজবুত করে

যাঁরা অস্টিওপোরোসিসে ভুগছেন বা হাড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে চিন্তিত, তাঁদের খাদ্যতালিকায় মথ ডাল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড়কে শুধু মজবুতই করে না, বরং হাড়সংক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ করে।

২. রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়

মথ ডাল খেলে দেহে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকবিরোধী প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে।
এতে থাকা জিংক (দস্তা) ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে এবং নানা রোগ প্রতিরোধ করে।

৩. ওজন কমাতে সহায়তা করে

উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন এখন জনপ্রিয় এবং মথ ডাল সেদিক থেকে বেশ উচ্চমানের।
এটি শরীরের মাংসপেশি পুনর্গঠন করে এবং শরীরের শক্তি বজায় রেখে ওজন কমাতে সহায়তা করে।

৪. হজমে সহায়তা ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে

মথ ডালে আছে প্রচুর আঁশ (ফাইবার), যা হজমপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এটি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয়।

৫. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায়

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন মথ ডাল খেলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমে।
এতে থাকা জিংক মানসিক প্রশান্তি আনতে সাহায্য করে।

৬. ভিটামিন বি-এর ভান্ডার

ভিটামিন বি মানবদেহের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য।
অনেক নিরামিষভোজী শুধু খাদ্যের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি পান না, কিন্তু মথ ডাল হলো বি কমপ্লেক্সের উৎস, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শক্তি বাড়ায় এবং কোষের বিপাকক্রিয়া উন্নত করে।

মথ ডালের প্রচুর স্বাস্থ্যগুণ আছে
মথ ডালের প্রচুর স্বাস্থ্যগুণ আছে

৭. হৃদ্‌যন্ত্র রক্ষা করে

হৃৎপিণ্ড শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। খাদ্যাভ্যাস এর ওপর বড় প্রভাব ফেলে।
উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল হৃদ্‌রোগের কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলেন, আঁশযুক্ত খাবার হৃদ্‌রোগীদের জন্য ভালো। তাই নিয়মিত মথ ডাল খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।

ত্বকের জন্য মথ ডাল

এ ডাল শুধু ভেতরের স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, ত্বকের জন্যও উপকারী।
মথ ডাল এক্সট্র্যাক্ট বর্তমানে বিউটি প্রোডাক্টে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ, এটি রেটিনলের মতো কার্যকারিতা দেখায়, ত্বককে তরুণ্যদীপ্ত ও উজ্জ্বল রাখে।

উপকারী মথ ডালকে বিষে পরিণত করে টারট্রাজিন নামের হলুদ রং

যেকোনো প্রাকৃতিক খাদ্য উপকরণেরই বিভিন্ন উপকারিতা থাকে। মথ ডালের জন্যও তা সত্যি। অথচ ক্ষতিকর টারট্রাজিন নামের হলুদ রঙের কারণে এটি বিষে পরিণত হচ্ছে। এটি একটি কৃত্রিম হলুদ রং, যা নানা অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে, যেমন চুলকানি, চামড়ায় ফুসকুড়ি ও অ্যাজমা। দেখে নিন এই হলুদ রঙের ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো:

অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া

অ্যাজমা: সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে টারট্রাজিন অ্যাজমার উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে।

হাইভস (চামড়ার ফুসকুড়ি): চুলকানি ও ফুসকুড়ি হতে পারে

অন্যান্য উপসর্গ: উদ্বেগ, মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, ঘুমের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

ক্ষতিকর টারট্রাজিন নামের হলুদ রঙের কারণে মথ ডাল বিষে পরিণত হচ্ছে
ক্ষতিকর টারট্রাজিন নামের হলুদ রঙের কারণে মথ ডাল বিষে পরিণত হচ্ছে
হলুদ মুগ ডাল বলে চালানো হয় এই সস্তা ডাল
হলুদ মুগ ডাল বলে চালানো হয় এই সস্তা ডাল

আচরণগত প্রভাব

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, টারট্রাজিন শিশুদের অতি সক্রিয়তা, অস্থিরতা ও খিটখিটে স্বভাব বাড়াতে পারে, বিশেষ করে যারা এডিএইচডিতে আক্রান্ত। এটি মনোযোগ কমিয়ে দিতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় টারট্রাজিনযুক্ত পণ্যে সতর্কতামূলক লেবেল দেওয়া বাধ্যতামূলক, যেখানে লেখা থাকতে হয়—‘এটি শিশুদের আচরণ ও মনোযোগে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে’। আর তা–ও খাদ্য নয়, সাধারণ অন্যান্য পণ্যে।

ভিজিয়ে রাখলে সাদা হয়ে যায় মথ ডাল
ভিজিয়ে রাখলে সাদা হয়ে যায় মথ ডাল
আমাদের দেশে খোসা ছাড়ানো হলুদ মুগ ডাল বিক্রি করা হয়
আমাদের দেশে খোসা ছাড়ানো হলুদ মুগ ডাল বিক্রি করা হয়

দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি

ডিএনএর ক্ষতি: গবেষণায় দেখা গেছে, টারট্রাজিন জেনোটক্সিক প্রভাব ফেলতে পারে এবং ডিএনএর ক্ষতি ঘটাতে পারে।

অক্সিডেটিভ স্ট্রেস: এটি কোষের ক্ষতি ও বার্ধক্য ত্বরান্বিত করতে পারে।

অঙ্গের ক্ষতি: দীর্ঘ সময় বা বেশি পরিমাণে গ্রহণে লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ক্যানসারের আশঙ্কা: যদিও প্রমাণ একেবারে সরাসরি নয়, তবে কিছু গবেষক মনে করেন, এর ডিএনএ ক্ষতির প্রবণতা, বিপাকক্রিয়ার ধরন, কোলন ক্যানসারসহ কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

প্রাকৃতিক মথ ডাল নয়, বরং এতে ব্যবহৃত টারট্রাজিনের কারণেই তা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা। অসাধু ব্যসায়ীরা লাভের আশায় এই বিষ মিশিয়ে দেশের শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষকে ঠেলে দিচ্ছেন অপূরণীয় স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে। তাই আমাদেরই সচেতন থাকতে হবে ভোক্তা হিসেবে। একটা দিক হচ্ছে, মথ ডাল সেদ্ধ হতে অনেক বেশি সময় নেয়। আর মুগ ডাল পানিতে ভেজালে বা সেদ্ধ করতে গেলে প্রথমেই রং ছেড়ে দিলে বোঝা যাবে এতে ভেজাল আছে। সেই সঙ্গে আমাদের সচেতন হয়ে ও জনমত গড়ে তুলে এসব ব্যবসায়ী ও আমদানিকারককে আইনের আওতায় আনতে সচেষ্ট হতে হবে।

সূত্র: বিএফএসএ ডট গভ, বিএফএসএ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হেলথলাইন, ভেরি ওয়েল হেলথ

ছবি: ইন্সটাগ্রাম

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৫: ৩১
বিজ্ঞাপন