মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে, নাকি বাঁচার জন্য খায়? আমার কাছে এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, মানুষ বেঁচে থাকার পূর্ণতা তখনই পায়, যখন সে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাঁচতে পারে। শুধু খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকলে সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবী হয়ে লম্বা সময় ধরে খাওয়ার সুযোগ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনই শুধু বাঁচার জন্য খেলে, জীবনের একটা বড় সুখ অর্থাৎ রসনাসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্যময় বিশাল রন্ধনশিল্প থেকে নিজেকে দূরে রাখা মানেই পঞ্চইন্দ্রিয়ের তিন ইন্দ্রিয়—জিহ্বা, চোখ ও নাকের ১০০ শতাংশ সদ্ব্যবহার না করা।
দেশে বা বিদেশে কোথাও বেড়াতে গেলে সবার মতো আমিও সেখানকার আকর্ষণীয় স্থান ও স্থাপনার খোঁজখবর নিয়ে সেগুলো দেখার চেষ্টা করি। তবে এর বাইরেও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা, তাঁদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা এবং স্থানীয় খাবারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা আমার থাকে।
এই যেমন এবার মরক্কোর মারাক্কেশ শহরে ঘুরতে গিয়ে সেখানকার স্থানীয় খাবারদাবারের ওপর রীতিমতো গবেষণা করে কী কী খাওয়া যায়, সেগুলোর ছবি ও বর্ণনাসহ একটি ‘উইশ লিস্ট’ বা ইচ্ছা তালিকা তৈরি করি। এরপর প্রিন্টআউট নিয়ে কাঁধের ব্যাগেই রেখে দিই। কারণ, দরকার হলে রেফারেন্স হিসেবে কাজে দেবে; অর্থাৎ তালিকা দেখে খাবারের অর্ডার করতে পারব। আমার সঙ্গে অবশ্য লাইব্রেরি থেকে নেওয়া মারাক্কাশের ওপর একটি পকেট গাইডও ছিল। যা হোক, আমার তালিকায় থাকা তিনটি খাবারের কথা এখানে লিখছি।
তাজিন (Tagine) নিঃসন্দেহে মরক্কোর আইকনিক খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। গম্বুজ আকৃতির মাটির ঢাকনা এবং থালার ভেতরে রান্নার উপাদানগুলো সাজিয়ে চুলার ওপর রেখে এটা তৈরি করা হয়। খাবারটির নাম রান্নার পাত্রের নাম ‘তাজিন’ থেকেই এসেছে, যা দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পিঠা বানানোর সরার মতো। সাধারণত মাছ, মুরগি বা ভেড়ার মাংসের সঙ্গে ভেষজ, মসলা, আলু বা অন্যান্য সবজি দিয়ে এটা তৈরি করা হয়।
একদিন হেঁটে হেঁটে পুরোনো শহরের মূল কেন্দ্র অর্থাৎ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ জামা এল-ফিনা চত্বরে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে স্থানীয় একটি খাবারের দোকানে তাজিন রান্না হচ্ছে দেখে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর বাবুর্চির কাছে কী রান্না হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকনা উঁচিয়ে খাবারটি দেখিয়ে দেন। খাবার দেখে পছন্দ হওয়ায় দাম জিজ্ঞেস করে আমাকেও একটা দিতে বলি। তারপর গোলাকার বানরুটির সঙ্গে সাধের তাজিন খাওয়া হয়। মরুভূমিতে ঘুরতে গিয়েও স্পেশাল ডিনার হিসাবে একদিন তাজিন খেয়েছি। তবে ওখানে রান্নার দৃশ্যটি যেহেতু নিজের চোখে দেখা হয়নি, তাই পেটের ক্ষুধা মিটলেও চোখের ক্ষুধা থেকেই যায়!
তাঞ্জিয়া (Tangia) মরক্কোর আরেকটি বিশেষ খাবার যা কলস আকৃতির টেরাকোটা মাটির পাত্রে রান্না করা হয়। মজা করেই বলা হয় কিনা জানি না; তবে শুনেছি তাজিন এবং তাঞ্জিয়া নাকি আলাদা জেন্ডারের, একটা পুরুষ আর অন্যটা নারী! সাধারণত ভেড়া বা অন্য কোনো মাংসের সঙ্গে সংরক্ষিত লেবু, জিরা, রসুন, জাফরান, জলপাই তেল ইত্যাদি উপকরণ কলসিতে ভরে সেটি সিল করে দেওয়া হয়।
এরপর সেই কলসি আগুনের আঁচে বা চুলার তাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধীরে জ্বাল দিয়ে এটি রান্না করা হয়। অনেকটা আমাদের দেশে ইদানীং জনপ্রিয় ‘হান্ডি মাংস’ রান্নার মতো। এতে যেহেতু শুধু মাংসই থাকে, তাই আমি বুদ্ধি করে ওদের গোল বানরুটি দিয়ে না খেয়ে বাইরের দোকান থেকে আলাদা করে স্থানীয় পরোটা অর্থাৎ মেসমেন (Msemen) নিয়ে এসেছিলাম। অতঃপর মজা করে মধ্যরাতের পরোটা–মাংস ভেবেই এটি খাওয়া হয়।
কুসকুস (Couscous) মূলত উত্তর আফ্রিকার খাবার। ভেজা এবং গুঁড়া গম বা বার্লি হাতে গড়িয়ে ছোট ছোট নরম দানা বানিয়ে সেটিকে ষ্টিম করে কয়েক রকমের সিদ্ধ সবজি এবং মাংস দিয়ে সার্ভ করা হয়। আমার ধারণা, আমাদের দেশের গরম ভাপা পিঠা ঝুরা ঝুরা করে সঙ্গে অল্প মসলা দিয়ে রান্না করা সবজি এবং মাংস দিয়ে খেতে হয়তো কুসকুসের মতোই হবে। রান্নাটা অবশ্য সময় নিয়ে করতে হয় এবং হাতযশেরও দরকার হয়।
আমার খাওয়ার তালিকায় এটি ছিল বলে প্রথম দিনেই হোটেলের অ্যাটেনডেন্ট আমিনাকে জিজ্ঞাসা করি, কোথায় ভালো কুসকুস পাওয়া যায়। সে জানায়, টুরিস্টদের জন্য কিছু রেস্টুরেন্ট প্রতিদিনই এটি তৈরি করে তবে আসল কুসকুস খেতে হলে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, কুসকুস এখানকার আমজনতার শুক্রবার দুপুরের বিশেষ খাবার। সেই মতো আমিও শুক্রবার সকালে মহল্লার সবচেয়ে ভালো কুসকুস কোথায় পাওয়া যায় জেনে নিয়ে জুমার পর সেখানে গিয়ে হাজির হই।
গিয়ে দেখি, আমাদের দেশের মতোই লাইন ধরে লোকে খাবার কিনছেন এবং রাস্তার পাশেই বসানো টেম্পোরারি চেয়ার–টেবিলে বসে খাচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য পার্সেল করেও নিয়ে যাচ্ছেন। দোকানের ছেলেটি নিজে থেকেই আমাদের অন্য এক জায়গায় চেয়ার–টেবিলের ব্যবস্থা করে বসায়। অতঃপর সাধের কুসকুস খেয়ে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হোটেলে গিয়ে হালকা ঘুম দিই!
আমার তালিকার বাইরেও কিছু খাবার খেয়েছি, বিশেষ করে স্ট্রিট ফুড। এই যেমন মাছ ভাজা, কালামারি, স্যান্ডউইচ, কাবাব ইত্যাদি। তবে আমি স্বাদ নিয়েছি অন্যরকম দুটি খাবারের কথা এখানে লিখছি।
বাব্বুচে (Babbouche) অর্থাৎ শামুক ও স্যুপ আমার খাওয়া অন্যরকম একটি স্ট্রিট ফুড। সন্ধ্যার পর আমার হোটেলের গলির মোড়ে চার চাকার ভ্যানের ওপর বড় সসপ্যান চাপিয়ে একজন কিছু একটা বিক্রি করত। ভ্যানটি ঘিরে জটলা থাকত, আর লোকটি লম্বা চামচ দিয়ে সসপ্যান থেকে ছোট ঘুটির মতো দেখতে কিছু একটা বের করে মাটির ভাঁড়ে সবাইকে দিত। সঙ্গে দিত দুটি ছোট চায়ের কাপে সসপ্যান থাকা তরল কিছু একটা। দুদিন দূর থেকে এই দৃশ্য দেখার পর হোটেলের অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এর নাম বাব্বুচে। ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখি, বাব্বুচে মরক্কোর এক স্ট্রিট ফুড, যা মূলত শীতকালে খাওয়া হয়। এতে ১২ থেকে ১৫ রকমের মসলা, যেমন গোলমরিচ, জিরা, আদা, মৌরি, পুদিনা ইত্যাদি পানিতে মিশিয়ে কম আঁচে দীর্ঘক্ষণ জ্বাল দিয়ে মাটিতে থাকা শামুক সেদ্ধ করা হয়। তারপর মাটির ভাঁড়ে সার্ভ করা হয়, সঙ্গে চায়ের কাপে এরই ঝোল বা স্যুপ।
তৃতীয় সন্ধ্যায় আমিও গিয়ে ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে কাছ থেকে লোকজনের খাওয়া দেখি। এক হাতে মাটির ভাঁড় নিয়ে অন্য হাতে টুথপিক দিয়ে শামুকের ভেতরের মাংসল অংশ বের করে মুখে পুরে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে চায়ের কাপ থেকে চুমুক দিয়ে সামান্য স্যুপও খাচ্ছে। সবার ভাব দেখে মনে হলো, আমাদের দেশে ফুচকা খেয়ে লোকজন যেমন মজা পায়, এরাও সে রকম মজাই পাচ্ছে। লোকটিকে ইশারায় আমার জন্য এক ভাঁড় শামুক এবং এক কাপ স্যুপ দিতে বললাম। তবে হ্যাঁ, দেখে এবং গন্ধ শুঁকে এই খাবার খাওয়ার জন্য সাহসের দরকার! প্রথমে আমারও নার্ভাস লেগেছিল, তবে পরে মজা পেয়ে যাই। এমনই মজা পাই যে অন্য সবার মতো আমার ভাঁড়ের শামুক ও কাপের স্যুপ শেষ হয়ে গেলে ফাউ হিসেবে বাড়তি শামুক এবং আরেক কাপ স্যুপ নিই।
বাষ্পে সেদ্ধ ভেড়ার মাথা বা ষ্টিমড শিপ হেড (Lahem Ras) আমার খাওয়া আরেকটি অন্যরকম খাবার। এটি এখানে বেশ জনপ্রিয় খাবার, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন করে মানুষ এটি খায়। বছরের অন্যান্য সময়ও স্ট্রিট ফুড হিসেবে পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও মাথা খাওয়া হয়, তবে এদের রান্না করা এবং খাওয়ার প্রক্রিয়াটি আলাদা।
প্রথমে মাথাটি চামড়াসহ কয়লার আঁচে পুড়িয়ে কালো করে নেওয়া হয়। এরপর চেঁছে কালো দাগ পরিষ্কার করে ভালো করে ধুয়ে নেওয়া হয়। এরপর আস্ত রেখে বা কয়েক টুকরা করে লবণ, জিরা অথবা গোলমরিচ মাখিয়ে ঘণ্টা দেড়েক ধরে বাষ্পে সেদ্ধ অর্থাৎ ষ্টিম করা হয়। এরপর মাংসল অংশ ছাড়িয়ে ওজন করে বিক্রি করা হয়। সাধারণত রুটি দিয়েই এটি খাওয়া হয়। চাইলে অবশ্য আবারও গ্রিল করে বা ভেজে খাওয়া যায়। খাওয়ার সময় অনেকে অতিরিক্ত লবণ, জিরা অথবা গোলমরিচের গুঁড়াও ছিটিয়ে নেয়। এটি দেখে হয়তো অনেকের খাওয়ার রুচি না–ও হতে পারে, তবে আমি সুযোগ পেয়ে ঠিকই ‘চেখে’ দেখেছি; কারণ, কথায় বলে, বুদ্ধিমান মানুষমাত্রই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণের এমন সুযোগ কি আর ছাড়া যায়।
জানুয়ারি ১৩, ২০২৪
ছবি: লেখক