ইন্টারনেটের এই যুগে ভাইরাল হওয়াটা আনন্দের বিষয় বলেই ধরা হয়। ক্রয়–সংস্কৃতির প্রভাবে রাতারাতি পণ্যের বিক্রি বেড়ে যায় ১০ গুণ। এমনই একটি পণ্য হলো দুবাই কুনাফা চকলেট। এই চকলেট প্রথম তৈরি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চকলেট কোম্পানি এফআইএক্স ডেজার্ট চকলেটায়ার। উপাদান হিসেবে তারা ব্যবহার করে পেস্তা ক্রিম, কুনাফা ও দুধ চকলেট। চকলেটের বারের ভেতরে আছে কুনাফা ও পেস্তার পুর।
এই চকলেট খেতে সুস্বাদু হলেও দাম অনেক বেশি। তাই প্রথমে টিকটক ইনফ্লুয়েন্সাররা বুদ্ধি আঁটেন রেসিপি দেখে এই চকলেট বানানোর। মাত্র তিন থেকে চারটি উপাদান ব্যবহার করে ঘরে বসে খুবই অল্প সময়ে বানিয়ে ফেলা যায় এই চকলেট। ২০২৩ সালে এসে টিকটকে একটি রিল ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই সবাই এ চকলেট নিয়ে শুরু করেন জল্পনাকল্পনা। আর কীভাবে এই চকলেটের সঙ্গে আরও নিরীক্ষা চালানো যায়। যতই আলাদাভাবে এই চকলেট তৈরির চেষ্টা করা হোক না কেন, পেস্তার স্বাদকে এই চকলেট থেকে আলাদা করতে পারেননি কেউ। ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই যে কুনাফা চকলেট বানানোর ট্রেন্ডের জোয়ারে বাজারে এখন পেস্তার সংকট।
বিশ্বজুড়ে এখন পেস্তার সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এর আরেকটি কারণ হিসেবে ২০২৪ সালে আমেরিকায় পেস্তার উৎপাদন কম হওয়াকে ধরা হয়। এরপর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহওর পেস্তা উৎপাদক হিসেবে ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরও ৪০ শতাংশ রপ্তানি বাড়িয়েছে। তাতেও ঘাটতি পূরণ হয়নি।
দুবাই কুনাফা চকলেটের জনপ্রিয়তার পর আরও অনেক কোম্পানি পেস্তা ফ্লেভারে আরও অনেক পণ্য বাজারে আনে। এতে পেস্তার চাহিদার চেয়ে সরবরাহ আগের চেয়ে আরও কমে যায়। এই ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আছে লিন্দিত, এমঅ্যান্ডএস ও ওয়েস্ট্রস।
পেস্তার দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। গত বছর এর দাম ছিল এক পাউন্ড ৭.৬৫ ডলার বা ৯৩০ টাকার কাছাকাছি। ২০২৫ সালে মূল্যবৃদ্ধি হয়ে এটি ১০.৩০ ডলার বা ১ হাজার ২৫০ টাকার সমপরিমাণ। এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু ভোক্তাদের ওপরই প্রভাব ফেলেনি, বরং চকলেট, আইসক্রিমসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য, যাতে পেস্তা ব্যবহার করা হয়, তার দামও এর ফলে হঠাৎ বেড়ে যায়।
পেস্তা দিয়ে তৈরি নতুন আইটেম যোগ করতে শুরু করায় সংকট এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে কয়েকটি দোকান বাধ্য হয়ে কুনাফা চকলেটের বিক্রিতে এমন শর্ত আরোপ করে, যাতে একজন ক্রেতা একসঙ্গে বেশি চকলেট কিনতে না পারেন। এরপরও কুনাফা চকলেটের বাড়তি চাহিদার জন্য পেস্তা ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেই স্টকে নেই, কিংবা স্টকে থাকলেও তা কেনার জন্য ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
পেস্তার এই হঠাৎ সংকট ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেস্তার গাছ বাড়তে বেশ সময় নেয়। আরও সময় লাগে ফল দিতে। তাই ভবিষ্যতেও পেস্তার এই বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না, এমনই ধারণা তাঁদের। এর পাশাপাশি পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান খরার ফলে পেস্তা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ দিনে দিনে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইরান ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো প্রধান উৎপাদক অঞ্চলগুলোও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বড় ঝুঁকির মুখে আছে।
খাদ্যবিশেষজ্ঞরা এই ট্রেন্ডকে দেখছেন না ইতিবাচক দৃষ্টিতে। ট্রেন্ড যেমন রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনি আবার দিন শেষে ট্রেন্ডের আবেদন মানুষের কাছে ফিকে হয়ে যায়। সুতরাং একটি ট্রেন্ডের কারণে পেস্তার মতো দামি ও স্বাস্থ্যকর ফসলের কৃষি-ভারসাম্য নষ্ট হওয়া কারোরই কাম্য নয়। তবে কুনাফা চকলেট প্রায় দুই বছর ধরে ট্রেন্ডে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। এর চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান দিতে না পারা কৃষিক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতার প্রকাশ।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম