হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও ক্যানসারের মতো মরণব্যাধির কারণ এই খাবার
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পুষ্টিবিজ্ঞানে বলা হয়, খাবার যত কম প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়া যায়, ততই ভালো। অথচ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন আলট্রাপ্রসেসড বা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার। আর এসব খাবারের অনেকটি আবার তথাকথিত ‘হেলথ ফুড’ গোত্রীয়। আপাতদৃষ্টিতে অতটা ক্ষতিকর মনে না হলেও আমাদের অজান্তেই দিনের খাদ্যতালিকায় থাকা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো ক্রমেই আমাদের ভয়াবহ সব শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আলট্রাপ্রসেসড খাবার কী

মূলত ২০০৯ সালের দিকে বিশ্বব্যাপী পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এই আলট্রাপ্রসেসড খাবারের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তথাকথিত জাংক ফুডের পাশাপাশি লো-ফ্যাট চিজ বা চিনিমুক্ত জুস ও হেলথড্রিংকের মতো ছদ্মবেশী সব খাবার আর পানীয় রয়েছে এই তালিকায়। বাণিজ্যিকভাবে খাবার ও পানীয়কে সুবিধাজনক, দীর্ঘমেয়াদি ও সুস্বাদু করে তুলতে বিভিন্ন তাপ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয় আলট্রাপ্রসেসিং। বিভিন্ন গবেষণায় এই আলট্রাপ্রসেসড খাবারের সঙ্গে ভয়াবহ সব স্বাস্থ্যঝুঁকির যোগসূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এখনো আমাদের আধুনিক জীবনে প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় এ ধরনের খাবার ও পানীয়ের দাপট কমছে না। ফলে বেড়ে চলেছে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত স্থূলতা এমনকি ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি।

বিজ্ঞাপন

আলট্রাপ্রসেসড খাবার চেনার উপায়

বোতল, বয়াম, ক্যান বা প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয় কিনতে গেলে উপকরণ—তালিকাটি মন দিয়ে পড়লে আলট্রাপ্রসেসিংয়ের আলামত মিলবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাদ্যযোগ্য উপাদান আর কসমেটিক অ্যাডিটিভগুলো দেখলেই সতর্ক হতে হবে। প্রসেস করা সয়া লেসিথিন বা হোয়ে পাউডারের প্রোটিন, ইনুলিন গোত্রের খাদ্যআঁশ, ভয়াবহ রকমের প্রক্রিয়াজাত শর্করা মলটোডেক্সট্রিন, ফ্রুকটোজ বা গ্লুকোজ সিরাপ আর হাইড্রোজেনেটেড ভেজিটেবল অয়েল—এই সবই লাল নিশান বলে ধরতে হবে। এদিকে বিভিন্ন রং, ফ্লেভার (প্রাকৃতিক উৎস হলেও), ক্যালোরিমুক্ত মিষ্টকারক উপাদান (প্রক্রিয়াজাত স্টেভিয়া), ফ্লেভার বৃদ্ধিকারক (নিউট্রিশনাল ইস্ট নির্যাস বা মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট) থিকেনার ও ইমালসাইফার (কেক, পাউরুটি, বিস্কুটের টেক্সচার বদলে দেয়)—এগুলোও থাকবে আলট্রাপ্রসেসড খাবার ও পানীয়ে। কিন্তু তথাকথিত অস্বাস্থ্যকর খাবার ছাড়াও অনেক খাদ্য এই গোত্রে পড়ে। এগুলো এবারে এক নজর দেখে নেওয়া যাক।

সকালের নাশতার সিরিয়াল

কর্নফ্লেক্স আর চকলেট, চিনি, ফ্লেভার ও রং দেওয়া সিরিয়ালগুলোকে বিজ্ঞাপনে কতই না স্বাস্থ্যকর বলে প্রচার করা হয়। অথচ এতে থাকে ওপরে বর্ণিত মলটোডেক্সট্রিন আর প্রক্রিয়াজাত আঁশ ও আমিষ। এতে যোগ করা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। ইন্সট্যান্ট ওটসও এর চেয়ে খুব একটা ভালো কিছু নয়।

প্রোটিন বার

যতই স্বাস্থ্যকর বলে দাবি করা হোক প্যাকেটের গায়ে এই প্রোটিন বার, সিরিয়াল বার, মুজলি বল, ওটস বার—সবই আলট্রাপ্রসেসড। প্রক্রিয়াজাত আঁশ আর প্রোটিন, মডিফায়েড স্টার্চ আর কৃত্রিম চিনি থাকবেই এগুলোয়।

ভিগান দুধ

কার্টনে বাজারজাত করা সয়া মিল্ক, আমন্ড মিল্ক আর ওটস মিল্ক এখন এ দেশেও মিলছে খুব সহজে। ট্রেন্ড মেনে কিনছে আর পানও করছে সবাই। কিন্তু এগুলোয় থাকে বিভিন্ন অতিপ্রক্রিয়াজাত ইমালসাইফার, ভেজিটেবল গাম আর ফ্লেভার। দুধের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি আমন্ড বাদাম বা সয়ার নির্যাসযুক্ত ‘দুধ’ ব্যবহার করা গেলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই।

বিজ্ঞাপন

পাউরুটি

প্যাকেটজাত পাউরুটির গায়ে যদি লেখা থাকে ইমালসাইফার, মডিফায়েড স্টার্চ আর ভেজিটেবল গামের কথা, তবে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় একে রাখা বিপজ্জনক। আমাদের দেশের বাণিজ্যিক বেকারিগুলো কী কী যোগ করে যে তুলতুলে পাউরুটি বানায়, তার তো কোনো হাদিসই নেই। তবে প্রাকৃতিক উপায়ে ইস্ট দিয়ে বানানো পাউরুটি খেলে ক্ষতি নেই।

ক্যানজাত খাবার

ক্যানজাত সুইট কর্ন, মাশরুম, অলিভ ইত্যাদির বহুল ব্যবহার দেখা যায় এখন আমাদের দেশেও। বয়ামের পাস্তা সসও ব্যবহার হয় ঘরে ঘরে। কিন্তু বিভিন্ন থিকেনার, ফ্লেভার এনহান্সার আর রং থাকায় আলট্রাপ্রসেসড খাবারের মধ্যে পড়ে এগুলো।

প্রসেসড মাংস

সসেজ, স্যান্ডউইচ স্লাইস, বেকন, নাগেট, সালামি—ইত্যাদি এখন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়েছে। ইমালসাইফার, মডিফায়েড স্টার্চ, থিকেনার, কৃত্রিম আঁশ থাকায় এগুলো অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিভিন্ন রং আর ফ্লেভারও থাকে এগুলোয়।

মার্জারিন

মাখনের বদলে লো-ফ্যাট মার্জারিন খেয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। তেলের হাইড্রোজেনেশন ঘটিয়ে রাসায়নিক উপায়ে বানানো এই স্প্রেডগুলোয় প্রচুর অ্যাডিটিভ থাকে। রং আর ইমালসাইফারও যোগ করা হয় এগুলোয়।

বর্তমান যুগে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সব খাবারেই প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। তবুও একটু দেখে-শুনে আলট্রাপ্রসেসড বা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে একটু বেশি সময় ব্যয় করে আর একটু দাম দিয়ে হলেও প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।

তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড হেলথ, ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন, হেলথলাইন।

ছবি: হালফ্যাশন ও পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ২২: ৩০
বিজ্ঞাপন