ভোজনরসিক বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যে মিষ্টি এক অদ্বিতীয় সঙ্গী। যদিও সে মিষ্টি আজকের যেসব মিষ্টি আমরা দেখি, তা নয়; বরং একেবারেই ঘরে বানানো। বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে শিখেছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে। সেটা ১৫০০ শতকে। সেই দিক থেকে দেখলে সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স দুই-আড়াই শ বছরের বেশি নয়। অবশ্য উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি লাড্ডুর বয়স দুই হাজার বছর।
লালমোহন বললেই সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘জটায়ু’ তথা লালমোহন গাঙ্গুলির কথাই মাথায় আসে। যতদূর জানা যায়, মিষ্টির মধ্যে লেডি কেনি আর সন্দেশ ছিল তাঁর প্রিয়। সত্যজিৎ কেন ‘লালমোহন’ নামে একটি গোটা চরিত্র লিখলেন, তা আর জানার সুযোগ হবে না। তবে বাঙালির মিষ্টি যে জগদ্বিখ্যাত, সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। উৎসব, আনন্দ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শোক, সুসংবাদসহ সবকিছুরই আদান–প্রদান হয় মিষ্টি দিয়েই।
পৃথিবীর সব দেশেই আছে মিষ্টি। সব দেশেই আছে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির নানা পদ। তবে আমাদের দেশের মতো এমন মিষ্টি যে আসলে খুব কমই আছে, তা বলাই যায়। সুমিষ্ট রসে টইটম্বুর একটা রসগোল্লা মুখে দেওয়ার পর সেই রস যখন মুখের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে; তখন স্বাদগ্রন্থিতে অপূর্ব অনুভূতির জোয়ার তোলে।
বাঙালির কাছে তাই বিদেশি মিষ্টির স্বাদ ফিকে মনে হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘রসগোল্লা’ গল্পে ‘ঝান্ডুদা’র ইতালির ভেনিস বন্দরে টিন ভ্যাকুয়াম প্যাকড রসগোল্লা বিদেশিদের খাওয়ানোর যে দৃশ্য বর্ণনা করেছেন, তা হলো, ‘তামাম চুঙ্গিঘর তখন রসগোল্লা গিলছে। আকাশে–বাতাসে রসগোল্লা। চুঙ্গিঘরের পুলিশ, বরকন্দাজ, চাপরাশি সকলের হাতে রসগোল্লা’, এতটাই মুগ্ধতা রয়েছে বাঙালির মিষ্টির স্বাদে।
পর্তুগিজদের পর বাঙালিই ছানা থেকে একের পর এক দুগ্ধজাতীয় খাবার বানাতে থাকে। শুরুতে এই মিষ্টি নির্মাতাদের বলা হতো ‘হালুইকর’। পরে তাঁদের নাম হয় ‘ময়রা’। আজও তাঁরা এ নামেই পরিচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, পাঁচ হাজার বছর আগে ঢাকার কাছে বিক্রমপুরে দুগ্ধজাত মিষ্টির আবির্ভাব ঘটে। আজও বলা হয়, বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর হাটে মেলে খাঁটি মিষ্টি।
ব্যক্তিগতভাবে মিষ্টিপ্রিয় মানুষ আমি। ইতিহাসের নগরী ঢাকার আনাচকানাচে রয়েছে অসংখ্য মিষ্টির দোকান। সেসব জায়গায় ঘুরে জানা গেল ঢাকাই মিষ্টির ইতিহাস, যার শুরু ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ আমলে।
বর্তমানে টিকে থাকা ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো মিষ্টির দোকান হলো ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’। ‘আলাউদ্দিন হালুয়াই’ নামের এক ব্যক্তি ভারতের লক্ষ্ণৌ থেকে পুরান ঢাকার চকবাজারে এসে ১৮৬৪ সালে এই মিষ্টির দোকান শুরু করেন। যেখানে জিলাপি, লুচি, হালুয়া, পরোটা, দই, মিষ্টি ইত্যাদি বিক্রি হতো। পরবর্তীকালে এই মিষ্টান্নের ব্যবসা সফলতা লাভ করার পর আলাউদ্দিন তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণ করার চিন্তা করেন। এ জন্য ১৮৯৪ সালে তিনি দোকানের নাম থেকে ‘হালুয়াই’ বাদ দিয়ে ‘সুইটমিট’ করেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে আধুনিক ঢাকার মিষ্টির আদি কারিগর এই আলাউদ্দিন হালুয়াই। তাঁর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় আধুনিক ঢাকার মিষ্টির। প্রায় ১৫০ বছরের দীর্ঘ অভিযাত্রা। কথা হয় নাজিমুদ্দিন রোডের আলাউদ্দিনের কারখানাসংলগ্ন ‘আলাউদ্দিন টেকঅ্যাওয়ে’র ম্যানেজার সানাউল্লার সঙ্গে। তিনি জানান, চার প্রজন্মের বেশি সময় ধরে তাঁরা সুনামের সঙ্গে করে যাচ্ছেন এই মিষ্টান্নের ব্যবসা। বর্তমানে চকবাজারে দুটি প্রধান শাখাসহ ঢাকার নিউমার্কেট, গ্রিনরোড, বিমানবন্দর, চানখাঁরপুল, নাজিমুদ্দিন রোড, মহাখালী, সিক্কাটুলী, নবাবপুর, নারিন্দা, কদমতলী ও নয়াবাজারে রয়েছে তাঁদের দোকানের শাখা। দেশের বাইরে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, লন্ডনের ব্রিকলেন ছাড়া সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কলকাতায়ও শাখা আছে আলাউদ্দিন সুইটমিটের।
২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল আলাউদ্দিন সুইটমিটের আদি ব্যবসা। ২০০৯ সালে আলাউদ্দিনের চতুর্থ প্রজন্ম হাজী মাহবুব দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসাটা আবার শুরু করেন। সানাউল্লা জানান, নাজিমুদ্দিন রোডের দোকানের পেছনেই মূল কারখানা। এখানে তৈরি হওয়ার পর গাড়িতে করে অন্য সব শাখায় পৌঁছে যায় মিষ্টি ও বেকারি আইটেম। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকান। মিষ্টির মধ্যে রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, বরফি সন্দেশ, আফলাতুন, মাওয়ার লাড্ডু ও মিহিদানার লাড্ডুর চাহিদা বেশি। বিভিন্ন রকম মিষ্টির দাম মোটামুটি ৩৮০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি।
এ ছাড়া সারা বছরই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আয়োজন, ঘরোয়া অনুষ্ঠান, মিলাদ-মাহফিল, বিভিন্ন ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে প্যাকেট করা মিষ্টি ও অন্যান্য স্ন্যাকসের প্রচলন রয়েছে। এসবের অর্ডারও আসে প্রচুর।
স্বাদ ও গুণগতমানে ভালো আর দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানকার বেকারি ও মিষ্টি পছন্দ করেন। সানাউল্লা জানান, পূজার সময় লাড্ডু ও আমিত্তি বিক্রি হয় বেশি। শবে বরাতের সময় বিশেষ রুটির প্রচলন রয়েছে পুরান ঢাকায়। তখন সবাই আলাউদ্দিনে আসেন এই রুটি কিনতে।
চকবাজারের বোম্বে সুইটসের মিষ্টির কথা জানা গেল পুরান ঢাকাবাসী শিশির চৌধুরীর কাছ থেকে। বকশিবাজার হয়ে উর্দুরোড দিয়ে চকবাজারে ঢুকতেই যে চার রাস্তার মোড়, সেখান থেকে চকবাজার শাহি মসজিদের রাস্তার শুরুতে হাতের বাঁদিকে পেয়ে যাবেন এই দোকান। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসা এই দোকানের মিষ্টির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, দিনে তৈরি হয়ে দিনে শেষ হয়ে যাওয়া; বিশেষ করে এখানকার কাঁচা ছানা পুরো ঢাকা শহরের মধ্যে সেরা। সব সময় তা পাওয়াও যায় না। তবে আলাউদ্দিন, আর তারপর বোম্বে সুইটসের হাত ধরে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো বিশেষ মিষ্টির বাক্সের যাত্রা, যা পুরান ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল সত্তর-আশির দশক থেকে। এখনো এসব বাক্স পাওয়া যায়। একসময় একটা বাক্সে আটটি ভিন্ন পদের বড় আকারের মিষ্টি থাকত। সময়ের সঙ্গে আকার ছোট হয়ে এসেছে।
ঢাকা শহরের বিখ্যাত তিন মিষ্টির ব্র্যান্ড ‘মরণচাঁদ’, ‘মহন চাঁদ’ ও ‘যাদব ঘোষ’। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময় থেকেই ঢাকা শহরের মিষ্টির ব্যবসায় অবদান রাখতে শুরু করে এই তিন হিন্দুধর্মাবলম্বী ময়রার মিষ্টির দোকান। আলাউদ্দিন হালুয়াইয়ের মুসলিম ঘরানার মিষ্টির পাশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা জমিয়ে বসে ঢাকা শহরে এই তিনটি মিষ্টির ব্র্যান্ড। এর মধ্যে তিন পুরুষের বেশি সময় অতিবাহিত করে ১৭০ বছরের পুরোনো মিষ্টান্ন ভান্ডার ‘মরণচাঁদ’ থেকে হয়েছে ‘মরণচাঁদ গ্র্যান্ড সন্স’। একই ঘটনা ঘটেছে বাকি দুটি মিষ্টির দোকানের ক্ষেত্রেও। প্রজন্মান্তরে সেগুলোও আজ ‘মোহনচাঁদ গ্র্যান্ড সন্স’ এবং ‘যাদব ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স’। এই ত্রয়ীর মিষ্টিই সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে ঢাকাবাসীর প্রিয় ছিল। নতুন ঢাকার লোকেরা নাম অতটা না জানলেও, ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে আজও কদর রয়েছে এই তিন দোকানের মিষ্টির। বিশেষ করে আদি মরণচাঁদ ঘোষ অ্যান্ড সন্সের।
পুরান ঢাকার নবাবপুর রোড দিয়ে সোজা ঢুকে রায়সাহেব বাজার মোড়ে এই ঐতিহ্যবাহী দোকানের অবস্থান। দোকানের হিসাবরক্ষক মামুন হোসেন জানান, এটাই আদি মরণচাঁদের প্রধান শাখা। এ ছাড়া ধানমন্ডির কলাবাগানে আছে আরেকটি শাখা। একই নামে অন্য যেসব শাখা রয়েছে, সেগুলো আসল নয়। বর্তমানে এর দায়িত্বে আছেন মরণচাঁদের নাতির ছেলে (প্রপৌত্র) হরিপদ ঘোষ।
সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই দোকান। এদের কাঁচা ছানা আর দই বিখ্যাত। দুর্গাপূজার সময় দশমীর দিন পুরান ঢাকাবাসীরা প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের বাসায় মিষ্টি পাঠান। সেখানে লাড্ডু ও আমিত্তি থাকে। মরণচাঁদের ‘মাষকলাইয়ের আমিত্তি’ ও ‘বেসনের লাড্ডু’র চাহিদা এ সময় বেড়ে যায় বলে জানান মামুন হোসেন। ২০ থেকে ২৫ রকম মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। রাজভোগ, রসগোল্লা, কালোজাম, লালমোহন, সাদা ও লাল চমচম, ল্যাংচা, ক্ষীরভোগ, কাটারিভোগ, মৌচাক, ক্ষীরের চপ আর অনেক রকম মিষ্টিই বিখ্যাত।
রায়সাহেব বাজারের মোড়ে মরণচাঁদের উল্টো দিকেই ‘আদি লাল চান গ্র্যান্ড সন্স’। বাসুদেব ঘোষের ছেলে জনি লাল ঘোষ জানান, তাঁরা তিন পুরুষ ধরে এই মিষ্টির ব্যবসা করছেন। ঘোষরা বংশপরম্পরায় মিষ্টি তৈরি করে আসছেন। তাঁরা ছানা ও মাঠা তৈরি করতেন। তিনি জানান, দোকানটি আগে মরণচাঁদের পাশেই ছিল, পরে এখানে চলে আসে। দুর্গাপূজার সময় সন্দেশ, আমিত্তি, লাড্ডু ইত্যাদি বিক্রি হয়। রমজান মাসে লাল চাঁদের বিখ্যাত মিষ্টি হচ্ছে ‘লাভরী’, যা দুধের সঙ্গে মালাই ও অল্প চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে ইফতারের পানীয় হিসেবে এই ‘লাভরী’ নিতে আসেন মুসলমানরা। লাল চান নিজেই এই ‘লাভরী’র প্রস্তুতপ্রণালির উদ্ভাবক।
জনি লাল ঘোষ আরও জানান, শীতের সময় বিশেষভাবে তৈরি হয় গুড়ের সন্দেশ, সাবুদানা, হাফসি, সরমালাই, মালাই চপ, কাটারিভোগ, ক্ষীরকদম। নিজস্ব খামারের দুধ থেকে তৈরি হয় বলে অন্যান্য দোকানের তুলনায় এখানকার মিষ্টির দাম কম। তাঁদের দোকানের দই, লাভরী ও রসগোল্লার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পূজা আর পহেলা বৈশাখে মিষ্টি বিক্রি হয় অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি।
এদের বাইরে পুরান ঢাকায় বেশ কিছু স্থানীয় ৫০ বছরের কমবেশি সময়ের পুরোনো মিষ্টান্নের দোকান রয়েছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে খুবই জনপ্রিয়।
এগুলো হলো, পাটুয়াটুলীর ‘দিল্লি সুইটস’, লালবাগের ‘মদিনা মিষ্টান্ন ভান্ডার’, নর্থ-সাউথ রোডের ‘মাজহার সুইটস’, নবাবগঞ্জ–হাজারীবাগ এলাকার ‘কায়সার সুইটমিট’, সাতরওজা আবুল হাসনাত রোডের ‘দয়াল ভান্ডার’, নারিন্দার ‘তানয়ীমস সুইটমিট’, নবাবপুরের গ্রিন সুইটমিট, গেন্ডারিয়ার ‘সোনামিয়ার মিষ্টি’ ইত্যাদি।
ছবি: শিশির চৌধুরী ও প্রতিবেদক