দুর্গাপূজায় লক্ষ্মীবাজারজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমাকে প্রণাম আর অঞ্জলি দিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসেন দর্শনার্থী। মণ্ডপ দেখার পাশাপাশি চলে খাওয়াদাওয়া। শাঁখারীবাজারজুড়েই রয়েছে বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান। পূজা দেখতে এসে এসব দোকানে ঢুঁ মারেন অসংখ্য দর্শনার্থী। ঠিক শাঁখারীবাজার-তাঁতীবাজার মোড়েই রয়েছে অমূল্য মিষ্টান্ন ভান্ডার। যেখানে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনে থাকে কয়েক পদের মিষ্টি।
কথা হলো রাজীব সাহার সঙ্গে। তিনি জানান, পৈতৃক মিষ্টির ব্যবসা তাঁদের। ১৯৭৫ সালে তাঁর বাবা প্রয়াত অমূল্য চন্দ্র সাহা এই দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে বংশপরম্পরায় চলে আসছে মিষ্টির ব্যবসা। পূজার জন্য তাঁরা আলাদা করে কিছু করেন না, তবে পূজার শুরু থেকে দশমী পর্যন্ত চাহিদা থাকে বিভিন্ন ধরনের লাড্ডু ও আমিত্তির। আর অষ্টমীর দিন বেশি বিক্রি হয় ছানা ও সন্দেশ। তাঁদের লাড্ডুর দাম লাড্ডুভেদে কেজিপ্রতি ৩২০ থেকে ৪০০ টাকা; আমিত্তি ৩২০ টাকা কেজি। চাহিদা অনুযায়ী এগুলো বেশি করে বানানো হয়। এ ছাড়া সন্দেশ ৪৮০, প্যারা সন্দেশ ৪০০, বাতাসা–নকুল ১৬০ টাকা।
পাশের পাটুয়াটুলী রোডেই রয়েছে আরেক বিখ্যাত মিষ্টির দোকান মহন চাঁন গ্র্যান্ড সন্স। দোকানটির প্রায় ২৭ বছর হয়ে গেছে। এর প্রতিষ্ঠাতার নাম মহন চাঁন এবং বর্তমানে তিনিই এখনো এই শাখার মালিক। পূজায় তাদেরও প্রধান আকর্ষণ লাড্ডু, আমিত্তি, কচুরি, নিমকি। লাড্ডু বানানো হয় দেশি বুটের ডাল দিয়ে। এর বাইরে দই, রসমালাই, নানা ধরনের মিষ্টি যেমন ল্যাংচা, মালাইকারি, আনন্দভোগ থাকে। লাড্ডুর কেজি ২০০, আমিত্তি ২০০, কচুরি ৩০০ ও নিমকি ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। লাড্ডুর মধ্যে বুন্দিয়া ও মাওয়ার লাড্ডু বেশি চলে।
শাঁখারীবাজারের আরেকটি পুরোনো মিষ্টির দোকান জয় মা মিষ্টান্ন ভান্ডার। এখানেও অন্যান্য মিষ্টির দোকানের মতো দই, রসমালাই পাওয়া যায়। দোকানের ম্যানেজার জানান, দুর্গাপূজা উপলক্ষে স্বাদের সঙ্গে ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে লাড্ডু বানানো হয়। জয় মা মিষ্টান্ন ভান্ডার প্রায় ২৪ বছর ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে। নারায়ণ চন্দ্র সেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তাঁর ছেলে শরৎ চন্দ্র সেন এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
মুন্সিগঞ্জভিত্তিক দুই মিষ্টির দোকান ‘ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডার’ ও ‘বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার’ রয়েছে ঢাকাবাসীর পছন্দের তালিকায়। যদিও মূল ভাগ্যকুল বাজারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত মিষ্টির দোকান আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ ও ‘চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডার’। ভাগ্যকুল ও বিক্রমপুরের মিষ্টি স্বাদে ও মানে কোনো অংশেই অন্যদের থেকে পিছিয়ে নেই।
কথা হয় বিক্রমপুর সুইটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিলয় ঘোষের সঙ্গে। তিনি জানান, কবে থেকে তাঁরা মিষ্টি বানাচ্ছেন, ঠিক জানা নেই তাঁর। প্রপিতামহসহ বংশানুক্রমে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে মিষ্টি বানিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। বিক্রমপুর থেকে ১৯৮১ সালে ঢাকার কলাবাগানে প্রথম বিক্রমপুরের আউটলেট খোলা হয়।
বাবু রমেশ চন্দ্র ঘোষ বিক্রমপুর সুইটসের সূচনা করেন। বর্তমানে চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি নিলয় ঘোষ এর দায়িত্বে আছেন। বিক্রমপুরের আসল আউটলেট চেনার উপায় হচ্ছে, সাইনবোর্ডের নিচে প্রধান শাখা কলাবাগান লেখা থাকবে এবং ভেতরে রমেশ চন্দ্রের ছবি থাকবে। নিলয় জানান যে ১০০ থেকে ১৫০ রকম মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। তাঁরা মিষ্টিতে যে দুধ ব্যবহার করেন, তার অধিকাংশই বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল বাজার থেকে আনা হয়। সেখানে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁদের আত্মীয়। বাংলাদেশের বাইরে তাঁদের শাখা নেই। কারণ, নিজেরা সরাসরি তদারক না করতে পারলে, গুণগতমান ঠিক থাকে না। এ জন্য শাখা খোলা হয় না বলে জানান নিলয় ঘোষ। তিনি আরও জানান, পূজার সময় সন্দেশ, লাড্ডু ও আমিত্তির চাহিদা বেশি থাকে।
ঢাকা শহরে মুসলিম সুইটস নামে অনেক দোকান রয়েছে। তবে এর আদি প্রতিষ্ঠাতা হাসান আলি ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আলি ১৯৬৭ সালে মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে প্রথম মালিবাগে একটি মিষ্টির দোকান চালু করেন। পরবর্তীকালে মুসলিম সুইটস নামে বিজয়নগরে ব্যবসা চালু রাখেন। এটাই এখন মূল শাখা।
নিজস্ব কারখানায় তৈরি মিষ্টি দিয়ে শান্তিনগর ও মালিবাগে দুটি শাখা পরিচালনা করছেন তাঁরা। দোকানের কর্মচারী তারিকুল ইসলাম জানান, প্রায় ২৫ রকম মিষ্টি আছে তাদের। সন্দেশের চাহিদা বেশি। মিষ্টি ছাড়া বেকারি আইটেমও আছে এখানে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য প্যাকেট খাবার সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
কথায় বলে, ‘মিষ্টি নিয়ে আদিখ্যেতা’। এত রকম মিষ্টির সম্ভারে যদি আদিখ্যেতা হয়েই যায়, তাতে ক্ষতি কী। উৎসব হোক আর আনন্দ আয়োজন, হোক না মিষ্টিমুখ। এই শারদ উৎসবে সবার মুখে ফুটে উঠুক হাসি। মেতে উঠুক সবাই জীবনের আনন্দে।
ছবি: শিশির চৌধুরী ও প্রতিবেদক