ইরানি সংস্কৃতিতে রুটি কেবল খাদ্য নয়, তাঁদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের সকালে উঠে বাড়ির কাছে বেকারিতে গিয়ে রুটি কেনা রীতির অংশ। ইরানে এমন অনেক শহর, গ্রাম আছে, যেখানে মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটার দূরত্বে একটি করে বেকারি থাকে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইরানিদের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রীতি। তাদের তিনটি ঐতিহ্যবাহী রুটি হলো সানগাক, বারবারি ও লাভাশ।
‘সানগাক’ শব্দের অর্থ ‘ছোট পাথর’। এই রুটি বিশেষভাবে ছোট ছোট নরম পাথরের ওপর বেক করা হয়। এর উৎপত্তি প্রাচীন পারস্যে। সৈন্যরা যুদ্ধের সময় নিজেদের বহনযোগ্য পাথর নিয়ে যেতেন এবং তার ওপর রুটি তৈরি করতেন। সে জন্য এখনো এই রুটিতে পাথর খুঁজে পাওয়া যায়। এই পাথর দাঁতে আটকানোর কারণে প্রচুর মানুষকে দাঁতের চিকিৎসা করাতে হয়।
বৈশিষ্ট্যগতভাবে প্রতিটি রুটি আলাদা। সানগাক খামিরযুক্ত, নরম ও কিছুটা খসখসে প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই রুটি প্রায় ৬০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। রুটি সেঁকার আগে এর ওপর তিল বা কালোজিরা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পাথরের তন্দুরে বেক করা হয়, ফলে মাটির কণা ও পাথরের ঘ্রাণ যুক্ত হয় রুটিতে। সানগাক কেবল রুটি নয়, এটি ইরানিদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা মনে করে, প্রতিটি মহল্লার নিজস্ব বেকারি থেকে রুটি সংগ্রহের অভ্যাস পারিবারিক সৌহার্দ্য এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়তে সাহায্য করে।
এই রুটি মোটা, খাঁজকাটা, খাস্তা স্বাদের হয়ে থাকে। বারবারি নামটি এসেছে ইরানের বারবারি জাতিগোষ্ঠী থেকে, যারা এ ধরনের রুটির প্রচলন করেছে। এটি ইরানের সবচেয়ে পরিচিত নাশতা। এই রুটির ওপর সরু খাঁজ কাটা থাকে, যাতে করে রুটি ফেটে না যায় এবং ভেতরটা সঠিকভাবে বেক হয়। তিল ও কালোজিরা দিয়ে সাজানো হয়। সাধারণত পনির, ডিম, জ্যাম বা মধু দিয়ে সকালের নাশতায় পরিবেশন করা হয়। একজন পর্যটকের ভাষ্যে, বারবারি রুটির প্রতিটি কামড়ে পাওয়া যায় ঘরোয়া, উষ্ণ স্পর্শ। এই রুটি দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরিয়ে রাখে। গরম চায়ের সঙ্গে খেতে চমৎকার লাগে।
অন্য দুটি রুটির তুলনায় এই রুটি পাতলা, নমনীয় হয়ে থাকে। স্বাদ তেমন আহামরি নয়। লাভাশ মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। আর্মেনিয়া, তুরস্ক, ইরান, আজারবাইজানে এটি বহুল ব্যবহৃত। যাযাবর ও মরুভূমির পরিবেশে এটি ছিল সহজে সংরক্ষণযোগ্য খাদ্য। এই রুটি খুব পাতলা ও নমনীয়, এতে কোনো ইস্ট ব্যবহার করা হয় না। রুটি লম্বা ও সহজে ভাঁজ করা যায় বলে এটি রোল, শর্মা, কাবাব দিয়ে মুড়িয়ে খাওয়া হয়। ঐতিহ্যগতভাবে তন্দুরের গরম দেয়ালে এটি সেঁকে তৈরি করা হয়। আধুনিকভাবে ঘরেও প্যানে বা ওভেনে সহজে বানানো যায় এই রুটি।
ইরানের রুটি শুধু খাবার নয় এটি ঐতিহ্যের বাহক, সামাজিকতার সেতুবন্ধ এবং প্রতিদিনের জীবনের সূচনা। আমেরিকায় বসবাসকারী প্রবাসী ইরানিরা দেশে বেড়াতে গেলে ফেরার সময় স্যুটকেসে করে রুটি নিয়ে আসেন। কারণ, ইরানে যেদিনের বেক করা রুটি সেদিন খাওয়া হয়। খুব বেশি হলে দ্বিতীয় দিন। তৃতীয় দিনে গেলেই তা পশুদের খাইয়ে দেওয়া হয়। সেখানে আমেরিকায় দুই তিন সপ্তাহের পুরোনো রুটিও গ্রোসারি শপে পাওয়া যায়।
আধুনিকতার মিশেলে কী করে ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হয়, তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ ইরান। ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা খাদ্যসংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধরে রাখাটাই দেশাত্মবোধ। এ ক্ষেত্রে ইরানিরা যেকোনো জাতির জন্য অনুকরণীয়।