আম উদ্যোক্তা হওয়া কিন্তু একেবারেই সহজ নয়। পচনশীল পণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সংরক্ষণের বেলায় সৎ থেকে লাভের অঙ্কে টান পড়ে অনেক সময়। বাগানি, পরিবহনকারী সংস্থা ও ক্রেতাদের সবার মধ্যে সমন্বয় করে রাত-দিন খেটে অনেক নারী আম উদ্যোক্তা হিসেবে সুনাম অর্জন করছেন। শর্মিলা রায় তাঁদেরই একজন। রংপুর হাট নামের একটি ফেসবুক পেজ দিয়ে যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। শর্মিলা সে পেজের দায়িত্ব পান ২০২০ সালের ঘোর করোনাকালে। সে সময়ে বাধ্যতামূলক গৃহবাসের দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই মূলত রংপুর হাটের কাজ শুরু করেন তিনি। চারটি আমবাগান কিনে ফেলেন শর্মিলা কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই। এরপর রংপুর হাটের হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম বাড়তে থাকে।প্রথম থেকেই এই উদ্যোগের সবকিছুতেই শর্মিলার পরিবার তাঁর পাশে রয়েছে। ভবিষ্যতে রংপুর হাট নিয়ে আরও পরিকল্পনা আছে তাঁর। সব আমের মাঝে একটু আলাদা রকমের এই হাড়িভাঙা আম। এর আদ্যোপান্ত জানা গেল এই আম উদ্যোক্তার কাছ থেকে।
শর্মিলা বললেন, হাঁড়িভাঙা আম আকারের চেয়ে ওজনে বেশি হয়। ওপরের দিক মোটা ও নীচের দিক তুলনামূলকভাবে চিকন হয়। এর খোসা পাতলা, আম আঁশবিহীন। আমের আকারের তুলনায় আঁটি ছোট হয়। সাধারণত হাঁড়িভাঙা আম পাকলে বোটার কাছে হলুদাভ আভা দেখা যায়। হাঁড়িভাঙা আম পাকলে হয়ে ওঠে সুমিষ্ট। শর্মিলা বললেন, চিড়া,মুড়ি বা ভাত যেটার সঙ্গেই খান, এতে আলাদা করে চিনি বা গুড় যোগ করতে হবে না।
শর্মিলার বয়ানে, এই আমের আসল স্বাদের জন্য খেতে হয় লাল মাটির হাঁড়িভাঙা আম। একারণে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জের হাঁড়িভাঙা আম হচ্ছে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এখানকার আমের স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই একদম নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে শত কষ্ট হলেও পদাগঞ্জের আমই পাঠান শর্মিলা সবার জন্য। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী বদরগঞ্জ উপজেলার লাল মাটির বাগানের হাঁড়িভাঙা আম স্বাদে কাছাকাছি। তেমন পার্থক্য নেই। কিন্তু পলিমাটির বাগানের হাঁড়িভাঙার স্বাদ একেবারেই অন্যরকম। লাল মাটি ও পলিমাটির হাঁড়িভাঙা আমের স্বাদে আকাশপাতাল পার্থক্য, জানালেন এই রংপুরের মেয়ে।
শর্মিলার কাছ থেকে আরও জানা গেল, হাঁড়িভাঙা আমের আসল স্বাদ পেতে তা খেতে হয় একদম ঠিক সময়ে। আম পাকা শুরু হলে শক্ত শক্ত থাকতেই খেয়ে নিতে হয় এই আম। গলে যাওয়া হাঁড়িভাঙা আম খাওয়া যায় না। স্বাদ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। আম পাকা শুরু হলে সাধারণত আমের বোটার কাছে হলুদাভ আভা দেখা যায়। হলুদ রং দেখেই বোঝা যায় আম খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। তবে আমে হলুদ রঙ না আসলে আম টিপে দেখে বুঝতে হবে পাকা শুরু হয়েছে কিনা। হালকা নরম হলেই বোঝা যাবে এটি খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে।
বেশ সন্তুষ্টি নিয়ে শর্মিলা জানালেন, এবছর রংপুর হাটে হাঁড়িভাঙা আম যুক্ত হওয়ার পাঁচ বছর হবে। তিনি বলেন, সফলভাবে গত চার বছর আম সরবরাহ করতে পেরেছি সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সৃষ্টিকর্তার প্রতি এবং যারা বিশ্বাস রেখেছেন তাদের প্রতি। ক্রেতারা বিশ্বাস রেখেছেন বলেই আমরা কাজটি করতে পারছি। যারা আম কেনেন তাদের একটা বড় অংশ আমাদের রিপিট ক্রেতা। ২০২০ সাল থেকে শুরু করে এখনো তারা আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন।
একই বাগান থেকে প্রতিবছর রংপুর হাটের আম সরবরাহ করা হয়। এবছরও সাতটি বাগান লিজ নেওয়া আছে তাদের। শর্মিলা রায় বললেন, তাঁদের বাগানের আমের বৈশিষ্ট্য হলো
১.এগুলো লাল মাটির হাঁড়িভাঙা আম।
২. বাগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় না। অনেকেই আমের আকার বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক প্রয়োগ করে থাকেন, তাঁরা এই কাজটি করেন না। প্রাকৃতিকভাবে তাদের বাগানের আম যতটুকু আকারবিশিষ্ট হয় ততটুকুই। রাসায়নিক প্রয়োগ করে একে বড় করার চেষ্টা করা হয় না।
৩. পরিপক্ক আম গাছ থেকে নামানো হয়। গাছ থেকে নামানোর পর সেই আম পাঠানো হয় সবার কাছে। যেহেতু পরিপক্ক আমই গাছ থেকে নামানো হয় তাই কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে আম পাকানোর প্রয়োজন হয় না।
৪. গাছ থেকে আম নামানোর পর বোটা থেকে আঠা শুকানোর জন্য কিছু সময় আম রেখে দেওয়া হয়। তারপর প্লাস্টিকের ক্রেটে মাঝখানে কাগজ দিয়ে থরেথরে আম সাজানো হয়।
৫. পরিপক্ক কাঁচা আম সরবরাহ করা হয়। কুরিয়ার হয়ে ক্রেতাদের বাসায় যেতে যেতে সেই আম পেকে যায়। যেহেতু আম সরবরাহের জন্য রংপুর হাট কুরিয়ারের উপর নির্ভরশীল তাই দূরের ঠিকানায় গাছপাকা আম পাঠানো সম্ভব হয় না।
শর্মিলা বললেন, 'বাগানের মালিকদের সাথে এই কয়েক বছরে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই তেমন কোন সমস্যা হয় না। গাছে মুকুল আসার পর থেকে আম পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত সবকিছুর খেয়াল রাখা হয়। অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা সম্ভব হয় না। তাই যেখানেই থাকি ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আমাকে বাগানে মনোযোগ দিতে হয়'।
তিনি আরও বলেন, 'যেদিন গাছ থেকে আম নামানো হয়, সেদিন সকাল থেকে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে। প্যাকেজিংয়ের পুরোটা সময় নিজে তত্ত্বাবধান করি। এরপর কুরিয়ারের রসিদ বুঝে নিই। সেই রসিদের ছবি ক্রেতাদেরকে মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। এখনো পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই সবাই নিজেদের আম পেয়েছেন'। সবশেষে এই উদ্যমী আম উদ্যোক্তা বলেন, 'কেউ যখন সুন্দর করে আম কেটে ছবি তুলে ইনবক্সে বা পেজে পাঠান, আম খেয়ে কতটা ভালো লেগেছে তা জানান, তখন এক অন্য রকম অনুভূতি হয়'।
রংপুর হাটের ফেসবুক লিংক: https://www.facebook.com/groups/300345131028529
ছবি: শর্মিলা রায়