পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে কফির আড্ডায় মেতে ওঠার পাশাপাশি কেউ কেউ কফি খেতে আসেন একাকী। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করেন নিজের একান্ত সময়টুকু। এভাবেই দিনের বিভিন্ন সময় তো বটেই বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কফি হাউসগুলোতে এখন প্রাণের ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন সবাই। এখানে কফি আর স্ন্যাকস খাওয়ার পাশাপাশি আড্ডাও চলে সমানতালে।
২০১৩ সালে চট্টগ্রামে কফি হাউসে বসে আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি বই পড়া, ওয়াইফাই দিয়ে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করাসহ কফির কাপে আড্ডা দেওয়ার একটি প্রচলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে কফি হাউসগুলোতে। চাহিদা থাকায় তৈরি হয় নতুন নতুন কফি হাউসও। বর্তমানে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, দুই নাম্বার গেট, জিইসি, কাজীর দেউড়ী, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক কফি হাউসের দেখা মিলবে। স্বল্প দামে কফি খাওয়ার পাশাপাশি ইচ্ছেমতো আড্ডা দেওয়া, চেক ইন দেওয়া, বই পড়ার সুযোগ ও নিত্যনতুন ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়ার জন্য অনেকেই ভিড় জমান কফি হাউসগুলোতে। এসবের পাশাপাশি সত্যিকারের কফিপ্রেমীদের তো ভিড় লেগেই আছে বন্দরনগরীর কফি হাউসগুলোতে।
কথা হয় বারকোড ক্যাফের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে। তিনি শোনালেন ২০১৩ সালের ৯ জুলাই যাত্রা করা এই ক্যাফের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার গল্প। মাত্র ছয়জন কর্মচারী নিয়ে শুরু হওয়া বারকোড ক্যাফের ধারণক্ষমতা ছিল তখন ৪০ জন। আর বর্তমানে ক্যাফের কর্মচারী সংখ্যা ৩৫ আর ধারণক্ষমতা ১৩০। মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম বাইরের বিভিন্ন দেশের মতো চট্টগ্রামেও বেশ কিছু ক্যাফে থাকুক, যেখানে আন্তর্জাতিক মানের কফি বিনের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন সবাই। সেই সঙ্গে কফির প্রস্তুতি আর পরিবেশনাতেও আসবে বৈচিত্র্য। সেই চাওয়া থেকেই বারকোড ক্যাফের যাত্রা শুরু করা।’
মঞ্জুরুল হকের চিন্তার প্রতিফলন দেখা গেল বারকোড ক্যাফের কফি মেনুতে। এখানে এক্সপ্রেসো, মাকিয়াটো, ক্যাপাচিনো, আমেরিকানো, মোকাসহ প্রায় ছয় রকমের লাতে কফি পাওয়া যাবে। এসব কফি মিলবে ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২৮০ টাকায়। বারকোড ক্যাফের দুই নাম্বার গেট শাখা, মুরাদপুরের বারকোড ফুড জাংশান এবং ওমেরটা বারকোড গ্রুপের এই তিন চেইন দোকানে মিলবে এসব কফি। বারকোড ক্যাফেতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সামনের সুপরিসর দেয়ালজুড়ে চোখে পড়বে নানা ধরনের গ্রাফিতি। বিশ্বের বিভিন্ন মনীষীদের জীবনমুখী উৎসাহব্যঞ্জক বাণী দিয়ে সাজানো দেয়াল। খেতে খেতে এসব বাণী পড়ে হয়তো অনুপ্রাণিত হতে পারেন অনেকেই।
দুই নাম্বার গেট এলাকার মিলানো ক্যাফেতে ঢুকতেই দেখা গেল কেউ কফির কাপ হাতে নিয়ে ব্যস্ত মুঠোফোনে, কেউবা মশগুল আড্ডায়। টেবিলে টেবিলে ধূমায়িত কফির কাপ ঘিরে বসে থাকা বেশির ভাগ ক্রেতাই তরুণ-তরুণী। এখানে বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা। তিনি বলেন, ‘ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে এখানে খেতে আসি। এখানকার ক্যাপাচিনো কফিটা বেশ ভালো লাগে।’ ২০১৩ সালের অক্টোবরে নগরের প্রবর্তক মোড়ে যাত্রা শুরু হয় এই ক্যাফে মিলানোর। বর্তমানে প্রবর্তক মোড়ের সেই ক্যাফেটি স্থানান্তরিত হয়েছে দুই নাম্বার গেট এলাকায়।
পাশাপাশি মিলানো এক্সপ্রেস নামের আরও দুটি চেইন ক্যাফে খোলা হয়েছে নগরের হালিশহর ও প্রবর্তক এলাকায়। এই কফি হাউসে বর্তমানে প্রায় ৩৫ ধরনের কফি পাওয়া যায়। ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করে কফি খাওয়া যাবে এই ক্যাফেতে। মিলানো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোরহানুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন চট্টগ্রামে বিন কফি ছিল না। সেই সংস্কৃতি আমরা দিনে দিনে চালু করেছি। এখন বেশির ভাগ মানুষ ক্যাপাচিনো, লাতে, মাকিয়াতো—এসব কফির নাম জানে। চট্টগ্রামের মানুষের খাবারের অভ্যাসও এখন পরিবর্তন হয়েছে। এতে তরুণ উদ্যোক্তারাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।’
নগরের কাজীর দেউড়ী এলাকার ফ্রিওলেন্তো রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা গেল ভিড়। এখানে আড্ডা দিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া চার তরুণ নাজমুস সাকিব, আমির হামজা, আবদুল হাই ও পরশ নাথ। তাঁরা সবাই পরস্পরের স্কুলজীবনের বন্ধু। এখানে কেন আড্ডা দিচ্ছেন, এমন প্রশ্ন করতেই আমির হামজার উত্তর, ‘সপ্তাহের প্রতিদিনই ছোটাছুটি করতে হয়। বাইরে বের হলেই ট্রাফিক জ্যামে নাকাল হতে হয়। বন্ধের দিনগুলোতে তাই নির্ভেজাল আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে আসি এখানে। কফির সঙ্গে অন্য খাবারের স্বাদও উপভোগ করি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নীলিমা নাগ পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস। তবে লেখাপড়ার পাশাপাশি ভালোবাসেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতে। তাই সুযোগ পেলেই মন সতেজ করতে তিন বান্ধবী পূজা নন্দী, নুসরাত হোসাইন ও ইয়াসমিন আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চলে যান বিভিন্ন ক্যাফেতে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নগরের জিইসির মোড় এলাকার রিও ক্যাফেতে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।
চট্টগ্রমের অসংখ্য নামীদামি ক্যাফেতে খেয়েছেন বলে জানালেন তাঁরা। ধীরেসুস্থে খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যায় বলে ক্যাফেগুলো তাঁদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলে জানান এ তরুণীরা। এ ছাড়া ক্যাফেগুলোতে ভালো পরিবেশ ও নিরাপত্তা থাকায় তারুণ্যের আড্ডা বাড়ার পাশাপাশি পরিবার নিয়েও সবাই ছুটে আসতে দ্বিধা করেন না বলে জানান তাঁরা।