আন্তর্জাতিক শেফ দিবস: শেফরা এখন তারকা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

শেফ কথাটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে সাদা পোশাক আর সাদা লম্বা টুপি পরা রন্ধনবিশেষজ্ঞের চেহারা। আসলে ফ্রেঞ্চ কুকিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়েই এসেছে শেফ কথাটি। ভূগোলকের এই দিকে শেফ-এর ধারণা কিছুটা নতুন হলেও এখন আমাদের দেশের প্রশিক্ষিত শেফরা দেশ-বিদেশে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছেন। তারকাখচিত হোটেল ও বিশেষায়িত রেস্তোরাঁগুলোতে এখন দেশি শেফরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, দেশের নতুন প্রজন্ম এখন দেশ ওঃ বিদেশের তাবত নামজাদা শেফদের চেনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদেরকে ফলো করে আর নিজেরাও হতে চায় শেফ। আর চাইবে নাই বা কেন, এখন সারা বিশ্বেই স্বনামধন্য শেফদের তারকাখ্যাতি আকাশচুম্বী। 

গর্ডন র‍্যামজে
গর্ডন র‍্যামজে
ছবি: উইকিপিডিয়া

তারকা শেফ বললেই সবচেয়ে জনপ্রিয় গর্ডন র‍্যামজের কথাই মনে পড়ে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক রান্নার অনুষ্ঠানে বিচারকের ভূমিকা পালনের সুবাদে এই বৃটিশ শেফের অসাধারণ রন্ধনশৈলীর মতো নাকের আগায় উঠে থাকা বদমেজাজের নাটকীয় রূপটিও সকলের জানা। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁরই গুরু, ৩১ টি অর্থাৎ এ যাবতকালের সর্বাধিক মিশেলিন স্টারপ্রাপ্ত ফ্রেঞ্চ শেফ জোল রোবুশানেরও ছিল বেজায় রগচটা স্বভাব। চিরন্তন ফ্রেঞ্চ কুইজিন এই প্রয়াত সেরা শেফের হাতেই পেয়েছে পূর্ণতা।  নরম-সরম আর হাসি-খুশি জেমি অলিভার,  আবেদনময়ী আর খাদ্যরসিক নাইজেলা লসন তো সকলের প্রিয়। আরও আছেন বৈজ্ঞানিক তেলেসমাতি সহকারে রান্না বান্নার জন্য বিখ্যাত শেফ হেস্টন ব্লুমেনথাল,  ভারতীয় কুইজিনকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়া শেফ বিকাস খান্না,  বর্তমানে সর্বাধিক মিশেলিন স্টার পাওয়া শেফ অ্যালাইন ডুকাস,  জাপানি কুইজিনের ধারক বলে পরিচিত ইয়োশিহিরো মুরাতাসহ আরও অনেকে।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক শেফ দিবস

আজ ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক শেফ দিবস। ২০০৪ সালে বিখ্যাত শেফ ড. বিল গালাগার এই দিবসের প্রবর্তন করেন। এই পেশার প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে দিনটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের তরুণ প্রজন্মকে রন্ধনশিল্প ও খাদ্যসংস্কৃতির ব্যাপারে উৎসাহিত করা।

কাকে বলব শেফ

শেফ কথাটি বাণিজ্যিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রন্ধনশিল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফরাসি শেফ দ্য কুইজিন কথাটি থেকেই এর উৎপত্তি, যার অর্থ কিচেন বা রন্ধনশালার প্রধান। এখন শেফ বলতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কালিনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত ও স্বীকৃত হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রন্ধনবিশেষজ্ঞকেই বোঝায়। এই শেফ অনেক ধরনের হতে পারে, যার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নামকরণ ব্যবস্থা। বিভিন্ন পর্যায়ের শেফের প্রশিক্ষণ ও অর্জনের তালিকায় থাকে ভিন্নতা। আবার শেফের কাজ কী আসলে, সে প্রশ্ন আসতে পারে অনেকের মনে। তিনি আসলে কিচেনের প্রধান। মেনু পরিকল্পনা থেকে শুরু করে পরিবেশনা—সবকিছুই হবে তাঁর নেতৃত্বে।

থিওডুলে রাইবটের পেইন্টিং
থিওডুলে রাইবটের পেইন্টিং
ছবি: উইকিপিডিয়া

বিশ্বের প্রথম শেফ

অগাস্ট এস্কোফিয়ের
অগাস্ট এস্কোফিয়ের
ছবি: উইকিপিডিয়া

এই যে শেফের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে কিচেন চালানো—এই ধারণার জন্ম হয় ১৪ শতকে সামরিক বাহিনীর খাবার তৈরির সময়। তখনই শেফদের র‍্যাঙ্কিং সিস্টেমেরও প্রবর্তন করা হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন গাইডলাইন আসে শেফদের কার্যক্রমে। দেওয়া হয় নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম। বিভিন্ন পর্যায়ের শেফদের নামকরণ করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর রেস্তোরাঁ ও হোটেল ব্যবসায় নতুন জোয়ার এলে শেফদের কাজের ক্ষেত্র বহুগুণে বিস্তার লাভ করে। এই ধারাবাহিকতায় অগাস্ট এস্কোফিয়ের (১৮৪৬-১৯৩৫) ছিলেন পথিকৃৎ। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত এই রন্ধনবিশেষজ্ঞকেই আধুনিক শেফদের মধ্যে প্রথম হিসেবে ধরা হয়। এই ফ্রেঞ্চ শেফকে ‘কিং অব শেফস, শেফ অব কিংস’ বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

শেফের প্রকারভেদ

এক্সিকিউটিভ শেফ

এক্সিকিউটিভ শেফ বা শেফ দ্য কুইজিন কিচেন হায়ারার্কি বা রন্ধনশালার পদমর্যাদায় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকেন। সরাসরি রান্নায় অংশ না নিলেও তাঁরা মেনু পরিকল্পনা ও পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন। বছরের পর বছর কঠোর সাধনার পর শেফরা এ অবস্থানে পৌঁছান।

সু শেফ
এক্সিকিউটিভ শেফের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করেন সু শেফ। সহকারী শেফরা তাঁর নেতৃত্বেই পুরো কিচেনের কাজ করেন। এক্সিকিউটিভ শেফরা সু শেফের ওপরেই কিচেনের কাজগুলোর দায়িত্ব দেন।

শেফ দ্য পার্তি
কিচেনের প্রতিটি নির্দিষ্ট অংশের রান্নার দায়িত্ব থাকে শেফ দ্য পার্তির ওপরে। লাইনশেফ বা স্টেশনশেফও বলা হয় তাঁকে। তাঁর তত্ত্বাবধানেই সব কুক উপকরণ প্রস্তুত, রান্না ও পরিবেশন করেন কিচেনে।

কমি শেফ

প্রাথমিক পর্যায়ে এন্ট্রি লেভেল শেফরাই হচ্ছেন কমি শেফ। শিক্ষানবিশও বলা যায় এঁদের। তাঁরা সহকারী হিসেবে সিনিয়র শেফদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। উপকরণ প্রস্তুত ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কাজটিও কমি শেফের।

শেফ ইউনিফর্ম

মারি-আন্তোনি কারেম
মারি-আন্তোনি কারেম
ছবি: উইকিপিডিয়া

শেফ ইউনিফর্ম এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, সে পথ পাড়ি দিতে লেগেছে বহু বছর। বিশ্বের প্রথম তারকাখ্যাতি পাওয়া শেফ মারি-আন্তোনি কারেম ১৮২২ সালে প্রথম সাদা হ্যাট, ডবল ব্রেস্টেড জ্যাকেট আর তার ওপরে কোমরে অ্যাপ্রোন বেঁধে সবার সামনে আসেন। রান্নাঘরে হাজারও সস, মসলাপাতি আর দাগ লাগার মতো উপকরণ থাকার পরও শেফের এই ধোপদুরস্ত পোশাক–পরিচ্ছন্নতা তাঁর দক্ষতার পরিচয় দেয়, ভোক্তাদের করে আকৃষ্ট। বিখ্যাত শেফ অগাস্ট এস্কোফিয়ের প্রথম লন্ডনে তাঁর রেস্তোরাঁয় সব শেফদের বাধ্যতামূলক ইউনিফর্ম পরানোর ব্যবস্থা করেন।

শেফ হ্যাট

শেফের ট্রেডমার্ক লম্বা সাদা টুপিটির কিন্তু কিছু তাৎপর্য রয়েছে। দৈর্ঘ্যে যত লম্বা, শেফের অভিজ্ঞতালব্ধ অবস্থানও তত ওপরে। তক ব্ল্যাঞ্চ নামে পরিচিত এই বিশেষ হ্যাটে যত বেশি প্লিট থাকবে, শেফের রন্ধনশৈলী ও কারিগরি দক্ষতা ততই বেশি।

হিরো ইমেজ : শেফ শুভব্রত মৈত্র, ছবি তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১১: ০০
বিজ্ঞাপন