মি টাইমের মৌতাত
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ইতালিয়ান বেকারির ভেতর-বাইরে দুই জায়গাতেই ভিড়। লোকে দাঁড়িয়ে-বসে কফি গিলছে আর সমানে গালগল্প করে চলছে। কোথায় দুপুরে ভরপেট খেয়ে দুদণ্ড ভাতঘুম দেবে গা এলিয়ে, তা না করে কী সব তিতকুটে কফি উড়িয়ে সেই তো আবার কোমর বেঁধে কাজে লেগে যাবে। মাঝখানে এই যেটুকু বিরতি। কাজপাগলদের এই ক্ষণিকের জটলায় আর হানা দিলাম না। কফি-কেকের হাতছানি ফিরিয়ে দিয়ে চুপচাপ ব্যাজার মুখে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।

‘হেই বোনজরনো’! ইতিউতি চাইতে দেখি দোকানের মালিক হাতে ধরা সিগারেট অ্যাশট্রেতে বুজিয়ে দিয়ে আমাকেই ডাকছে। আসতে-যেতে এ বেকারিতে প্রায়ই ঢুঁ মারা হয়। মিষ্টি খাবারের প্রতি আমার মাছি স্বভাব তার খুব জানা। দু–একজন বাঁধা কাস্টমার ঠেলেঠুলে মাছি বেগমকে জায়গা করে দেওয়া হলো। ভনভনিয়ে উড়ে স্বচ্ছ কাচের ওপাশে দাঁড়ালাম। আজ দেখছি হরেক রকমের মন্ডা–মিঠাই সাজানো থরে থরে। পেটের গহিন থেকে চিকন স্বরে কে যেন চিঁ চিঁ বায়না ধরল, ‘মিষ্টি খাব, কিনে দাও, কিনে দাও...’। এমন মিহি আর দুর্বল স্বর বিবেক ছাড়া আর হবে? তবে সে তো শুনেছি হৃৎপিণ্ডের এপাশ নাকি ওপাশে থাকে। পেটের ওদিকটায় সে গেল কী করে। যাহোক, বিবেকের ডাকে সাড়া না দিলেই নয়।

বিজ্ঞাপন

ডার্ক চকলেট কেকের গাঢ় বাদামি জেল্লা দেখে চোখ ফেরানো দায়। তার পাশেই সফেদ চিজ কেকের শুভ্র আমন্ত্রণ। কিন্তু সব ছাপিয়ে নজর কেড়ে নিল এক থালা রঙিন ম্যাকারন। ক্রিম কুকিজের মতোই দুই পাশ থেকে ক্রিমের পুর চেপে রেখেছে। কিন্তু কুকিজের মতো রুক্ষ চেহারা নয়। বরং পেলব। কাঠবাদামে গড়ানো মসৃণ ত্বক। মৃদু আলো ঠিকরে চায়না পোরসেলিনের মতো ঝিলিক দিচ্ছে গোল চাকতিগুলো। কোনোটা স্ট্রবেরি জ্যামে ঠাসা, কোনোটা ভ্যানিলা সসে টইটম্বুর।

নানা রঙের ম্যাকারন
নানা রঙের ম্যাকারন
ছবি: পেকজেলসডটকম

বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, কমলা রঙে ম্যাকারনগুলো এক্কেবারে রংধনু উড়িয়ে দিয়েছে। যদিও জানি এ বাহার ফুড কেমিক্যালের কল্যাণে, তবু ঘোর লাগছে বড্ড। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব, ভেবে না পেয়ে আঙুল তুলে এলোপাতাড়ি দেখিয়ে বললাম, ‘এটা, ওটা–সেটা আর ওই যে ওইটা নেব।’

দোকানি টপাটপ ম্যাকারনগুলো কাগজের ঠোঙায় তুলে দিতে দিতে শুধাল, ‘সঙ্গে কফি নেবে না?’

বললাম, ‘তোমার ম্যাকারনের মিষ্টি খেয়েই তো টং হয়ে বসে থাকব। ওতেই কফির কাজ দেবে।’

দুষ্টু চোখ টিপে দোকানি মাথা নাড়ল, ‘তা তুমি পারোও বাপু।’

সহাস্যে তাকে ‘আদিও’ ঠুকে ইতালিয়ান কায়দায় বিদায় জানিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। দোকানিও বেরিয়েছে পিছু পিছু। আধখাওয়া বিড়িটা কার কাছ থেকে ধরিয়ে ফক ফক ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল সে।

বিজ্ঞাপন

সামনেই বাসস্টপ। খালি বেঞ্চি দখলে নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সেই রেনেসাঁ যুগে কোন এক ইতালিয়ান শেফ ফ্রেঞ্চদের প্রথম এই বস্তু বানিয়ে খাইয়েছিল। অতি ক্রিয়েটিভ ফরাসিরা রেসিপিতে নানা রকম অদল-বদল এনে ম্যাকারনকে এমনই নিজেদের করে নিল যে জিনিসটার নামই দাঁড়িয়ে গেল ফ্রেঞ্চ ম্যাকারন। ইতালিয়ান আবিষ্কারের ফ্রেঞ্চ নাম নিয়ে অবশ্য এ শর্মার মাথাব্যথা নেই। বরং গালের ভেতর চকলেট ফ্লেভারের ম্যাকারনটাকে বাগে আনার চেষ্টায় আছি। মুচমুচে শব্দে ভেঙে কেমন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে সেটা। তৃপ্তি মিলছে না কিছুতেই। পেটের ভেতর বিবেক বাবা আরও কতগুলো ফ্রেঞ্চ ম্যাকারনের জন্য হাঁ করে অপেক্ষা করছে।

ঠোঙার মুখখানা আবার খুলতেই এবার বেগুনি আভা ছড়িয়ে উঁকি দিল ব্লুবেরি ম্যাকারন। টপ করে তাকে ধরে মুখে পাঠিয়ে দিলাম। টক-মিষ্টি মিশেলের একটা কড়া স্বাদ যেন জোরসে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। সটান সোজা হয়ে বসে মুঠোয় ধরা প্যাকেট হাতড়াতে লাগলাম। জাদুর টুপি থেকে যেমন একের পর এক খরগোশ বেরোতে থাকে, ভচকানো ঠোঙা থেকে তেমনি বেরোতে লাগল ঝলমলে সব জাদুর মিঠাই।

কমলা ক্রিমের অরেঞ্জ স্বাদের ম্যাকারনের মচমচে পিঠে কামড় বসিয়েই দুই আঙুলে স্ট্যান্ডবাই পজিশনে রেখেছি লেমন জ্যামে ঠাসা হালকা সবুজ আরেক পিস। এর মাঝে শরিক জুটে গেছে একজন। বাসস্টপে মায়ের হাত ধরে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা বছর দুয়েকের এক জেন্টলম্যান। মুখ থেকে ললিপপ সরিয়ে জুলজুল করে সে এদিকেই তাকাচ্ছে। ফুলো ফুলো গাল বেয়ে হালকা লালার স্রোতও নামছে দেখি। তাকে আড়চোখে ভেংচি কেটে সল্টেড ক্যারামেল স্বাদের নোনা-মিঠা শেষ ম্যাকারনটা অবলীলায় মুখে চালান দিয়ে দিলাম। কচরমচর নির্মম শব্দে বেচারা কেঁদে উঠল, ভ্যাঁআআ...। বাচ্চার মা এদিকে নজর দেওয়ার আগেই চটজলদি আরেক দিকে রাস্তা মাপলাম।

আজকের দুপুরটা এত মিষ্টি! এলোমেলো হেঁটে নদীর পাড়ে চলে যেতে মন চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। ছেলেটাকে কিন্ডারগার্টেন থেকে তুলতে হবে সময়মতো। সুতরাং সেদিক বরাবর গতি বদলাতে হলো।

‘মা, কী খেয়েছ বলো তো? তোমার গা থেকে কেক-বিস্কুটের ঘ্রাণ আসছে কেন?’
জেরার মুখে স্বীকার করতে হলো রেস্তোরাঁয় নুডলস থেকে বেকারির ম্যাকারন অবধি। সব শুনে শোকে বিমূঢ় ছেলের এমন এক কাঁদো কাঁদো চেহারা হলো, যে পেটের ভেতর রীতিমতো বিবেকের দংশন টের পেলাম।

অপরাধ শুধরে নেওয়ার আশায় তাকে জবর অফার সাধা হলো, ‘আইসক্রিম চলবে? নদীর পাড়ে বসে?’  

পাঁচ মিনিটের মাথায় মোড়ের আইসক্রিমের দোকানে পৌঁছে গেলাম দুজন। সাইনবোর্ডে নাম লেখা ‘দোমোরি’। দোমোরিকে দোকান বললে ভুল হবে। রোমানিয়ান এক দম্পতির ছোট্ট আইসক্রিম পারলার আর পাতিসেরি এটা। নিজেরাই অর্গানিক আইসক্রিম, কেক আর চকলেট বানায়। কফির স্বাদও সমান দুর্দান্ত।

হাতে গড়া মিঠাই যত দোমোরির অন্দরে
হাতে গড়া মিঠাই যত দোমোরির অন্দরে
ছবি: লেখক

আমরা পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অপরূপ চেহারার অল্পবয়সী মেয়েটা আইসক্রিম বারের পেছন থেকে হাসিমুখে হাত নাড়ল। আজকের তার হাজব্যান্ডকে দেখছি না। তবে রোমানিয়ার লোকদের নারীভাগ্য বেজায় ভালো। এরা প্রত্যেকে অপ্সরা পর্যায়ের সুন্দরী। আমাদের দোমোরি–কন্যা শুধু অপ্সরা হয়েই ক্ষান্ত দেয়নি। তার হাতের আইসক্রিমের স্বাদ এই মিউনিখ শহরের আর কোথাও মিলবে না।

‘কী খবর, কী নেবে আজকে?’
ছেলের ঘ্যাও–ম্যাও শুরু হয়ে গেল, ‘আমি চকলেট। ওয়াফেল কোনে দুইটা বড় বড় গোল্লা দিতে হবে কিন্তু।’

‘আর আমি নেব জাফরান ফ্লেভার।’ আসলামই যখন, আইসক্রিম না খেয়েই বা যাই কী করে। সামনের দিনকয়েক না হয় ঘাসপাতা আর সালাদ খেয়ে পুষিয়ে দেব। মনকে একটা আধা সত্য ভুংচুং দিলাম আপাতত।

অর্গানিক আইসক্রিমের পসরা
অর্গানিক আইসক্রিমের পসরা
ছবি: লেখক

পায়ে পায়ে নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। ইজার নদী। মিউনিখের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে বহুদূর। বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে আরাম করে বসলাম অলস কতগুলো হাঁসের পাশে। আইসক্রিমে তাদের আগ্রহ নেই। নিরাসক্ত হাঁসের পালের পাশে আমরা দুজন চূর হয়ে আইসক্রিম খেতে লাগলাম চরম আসক্তের মতো।
দুপুর পেরিয়ে বিকেলের আলো নরম হয়ে জাফরান আইসক্রিমের সোনালি বরফদানা চুইয়ে পড়ছে। সেই ফাঁকে পেস্তাবাদামের অগুনতি কুঁচি উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দারুচিনি, লবঙ্গ আর এলাচির হালকা মিষ্টি গন্ধ নদীর ঠান্ডা বাতাসে মিলে একাকার। ক্ষীর, পায়েস, দই আর রসমালাই—সব স্বাদের যেন এক মিশেল এই বিচিত্র রোমানিয়ান জাফরান কুলফি। এ বাদশাহি জিনিস ঘাটের পাড়ে পাথুরে সিঁড়িতে বসে খাওয়া সাজে না। নিদেনপক্ষে একটা আরামকেদারা হলে মন্দ হতো না।

এই রেসিপি দোমোরি–কন্যা কোথায় পেয়েছে কে জানে। একবার জানতে গিয়ে জবাবে একগাল রহস্যময় হাসি মিলেছে। এটা তার ট্রেড সিক্রেট। বলতে নারাজ। আমিও কি আর ঘাঁটাবার মানুষ। ঘর থেকে দুপা ফেলে দুকড়ি দিলেই তো হাতে এসে ধরা দিচ্ছে এ মহার্ঘ।

জাফরান আইসক্রিম।
জাফরান আইসক্রিম।
ছবি: দোমারি

হাঁসেরা উড়ে গেছে। ছেলের ডবল চকলেট আইসক্রিম ফুরিয়েছে। হাতের জাফরান কুলফিও কখন হাপিশ, খেয়ালই নেই। উঠে দাঁড়ালাম আমরা। বাড়ি যেতে হবে।
মেঘের চাদরে সূর্য ঢেকে গেছে টুপ করে। অপূর্ব লাল-কমলা আভা আকাশজুড়ে। হিম হিম জাফরানি এক সন্ধ্যা নেমে আসছে এই ভিনদেশি শহরে।

লেখক: গবেষক, মিউনিখ, জার্মানি।

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২২, ০৬: ৪৬
বিজ্ঞাপন