আমি কি ওট মিল খাব? আমার এই প্রশ্ন শুনে চিকিৎসক ভেট্রানো হেসে ফেলেন। হ্যাঁ, খেতে পারেন। ওট মিল ভালো খাবার। তবে অনেকের ধারণা ওট হচ্ছে ওষুধ, এটা খেলে ডায়াবেটিস ভালো হয়ে যায়। ভাত-রুটির মতো ওটও কার্বোহাইড্রেট। তবে ওগুলোর চেয়ে ওট কিছুটা ভালো। এটা গ্লুটেনমুক্ত এবং এতে ফাইবার বেশি।
প্রথম প্রথম ওট মিল খেতে আমার তেমন ভালো লাগত না। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়েছি। পরিমাণমতো পানি আর লবণ দিয়ে তিন মিনিট সেদ্ধ করলেই আঠাল, থকথকে ওট মিল হয়ে যায়। লবণ-পানির পরিমাণ ও জ্বাল বেশি-কমে ওট মিলের স্বাদে বিরাট পরিবর্তন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ওট মিল রান্না করে আমি এটা শিখেছি। রান্না করা ওট বাটিতে নিয়ে আখরোট, চিয়াবীজ, স্লাইস করে কাটা পাকা কলা, আপেল বা অন্য কোনো মিষ্টি ফল কুচি করে কেটে ঢেলে দিই, এর ওপর ঠান্ডা দুধ ঢেলে চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে খেতে থাকি। এখন ওট মিল আমার খুব প্রিয় একটি খাবার।
পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষেরা সবকিছুকেই ইমপ্রোভাইজ করতে থাকে। রান্নাবান্নার ইমপ্রোভাইজেশনই সবচেয়ে বেশি করে মানুষ। পৃথিবীর সব বড় শেফ নিজের মতো করে রেসিপি তৈরি করেন। বাংলাদেশ ও ভারতেও অনেক রন্ধনশিল্পী আছেন, যাঁরা অসাধারণ সব রেসিপি তৈরি করেছেন। রান্নাবান্না নিয়ে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় যাঁদের অনুষ্ঠান দেখেছি, তাঁদের রান্নার মান ও সৃজনশীলতা বেশ নিম্নমানের মনে হয়েছে। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে এমন একজন রন্ধনশিল্পী অদ্ভুত অখাদ্য সব রান্না করে দেখাতেন। তাঁকে নিয়ে প্রচুর ট্রল হতো একসময়।
এখন ইউটিউবে প্রচুর রান্নার ভিডিও পাওয়া যায়, বেশ কিছু রন্ধনশিল্পী আছেন, খুব ভালো শিল্পসম্মত রান্নার ভিডিও পোস্ট করেন, তবে বেশির ভাগই অন্যান্য সব সেক্টরের মতো আবর্জনা। ‘আমার রান্নাঘর’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। একজন ভদ্রলোক হচ্ছেন সেই চ্যানেলের রন্ধনশিল্পী। তিনি রান্নার প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে করতে খুব মজার মজার কথা বলেন। একেকটি রান্না শেষ করে তিনি বলেন, ‘এসব অখাদ্য-কুখাদ্য রানবেন আর খাইবেন। বানাইবেন আর তামা তামা কৈরা খাইবেন।’ অপ্রমিত উচ্চারণে বলা তাঁর এসব কথা দর্শকের কাছে সসের মতোই উপাদেয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু খাবার রান্না করেছি, সেসব নিয়ে লিখেছি। রান্নার সঙ্গে আগুন আর চুলা অবধারিত। যা-ই রান্না করি না কেন, এমনকি কোনো একটি ভর্তাও, আগুন ছাড়া সম্ভব নয়। আলু, বেগুন, মাছ, শুঁটকি, লাউ, কুমড়ার খোসা, তিল, শর্ষে, তিসি, চিয়াবীজ, কালিজিরা—যেটারই ভর্তা বানাই, হয় ভেজে নিতে হবে, না হয় সেদ্ধ করতে হবে, অথবা পুড়িয়ে নিতে হবে। আগুন লাগবেই। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোয় ঠান্ডা খাবার খাওয়ার প্রচলন সুপ্রাচীন। সেসব খাবারের কিছু কিছু আছে, যা প্রস্তুত করতে আগুন লাগে না।
আজ আমি ইমপ্রোভাইজড ওট মিলের কথা বলব, যা তৈরি করতে চুলা বা আগুন লাগে না। এর নাম ওভারনাইট ওটস। উন্নত বিশ্বে তরুণ প্রজন্ম এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওভারনাইট ওটের ওপর। এ সময়ের ক্রেজ এখন ওভারনাইট ওট। এর প্রচলন শত বছরের পুরোনো হলেও একজন সুইস চিকিৎসক ম্যাক্সিমিলিয়ান বার্চার-বেনার তাঁর রোগীদের এই খাবার খেতে পরামর্শ দিতে শুরু করলে খাবারটি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমে সুইজারল্যান্ডে, পরে ইউরোপে, এখন প্রায় সব দেশেই। তিনি বলেন, ‘আমার রোগীদের বেশি বেশি ফল খাওয়ানোর কৌশল হিসেবেই আমি ওভারনাইট ওট খেতে পরামর্শ দিই।’
আগেই বলেছি ওভারনাইট ওট প্রস্তুত করতে আগুন বা চুলার দরকার নেই। তাহলে কীভাবে বানাবেন এই খাবার? ইউটিউবে গেলে হাজারটা রেসিপি মিলবে; নিজের রুচি, পছন্দ এবং উপকরণের সহজলভ্যতা অনুযায়ী বেছে নেওয়া যাবে যেকোনো একটি।
আমি, আমার স্ত্রী মুক্তি ও কন্যা নভো—আমরা তিনজনই এখন ওভারনাইট ওট খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মুক্তি ও নভো রোজ সাহ্রিতে ওভারনাইট ওট খেত। আমি অবশ্য রোজার সময় প্রথাগত খাবারগুলোই খেতে পছন্দ করি। ঢাকা শহরে বাঙালি মুসলমানদের যে রমজানের খাদ্যসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, দীর্ঘকাল ধরে আমি সেই খাবারগুলোই ইফতার ও সাহ্রিতে খাই। আমার কাছে ইফতারে বুট, পেঁয়াজু, বেগুনি দিয়ে মুড়ি মাখানো, হালিম, ইসবগুলের ভুসি দিয়ে লেবুর শরবত—এগুলো শুধু খাবার না, শৈশব-কৈশোর থেকে তুলে আনা হীরকখণ্ডের মতো একেকটি উজ্জ্বল স্মৃতিও।
যাহোক, ফিরে আসি সেই ওভারনাইট ওট প্রসঙ্গে। একটি বেঁটে, মোটা বোতল বা বয়াম নিলে ভালো হয়, না থাকলে বাটি নিলেও হবে। টেবিল চামচের চার চামচ ওট নিতে হবে। তাতে পরিমাণমতো দুধ ঢেলে দিতে হবে। এরপর পছন্দমতো মিষ্টি ফলের কুচি দিতে হবে। পাকা সাগরকলা অবশ্যই দেওয়া উচিত। কুচি করে কেটে খেজুরও দেওয়া যেতে পারে। আমি চিনি বা মধু দিই না। নভো মধু দেয়। আপেলকুচি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি, রাস্পবেরি—এসব দিই আমি। কিছু চিয়াবীজ অথবা তোকমার দানাও দেওয়া যায়। নারকেলের ফ্লেক্সও। এরপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে বোতলটা ফ্রিজে রেখে দিতে হবে।
কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সময় দিলে ভালো হয়, আরও বেশিও দেওয়া যেতে পারে। দুই দিন পর খেলেও ক্ষতি নেই। খাওয়ার আগে বের করে কিছু আখরোট মেশানো যেতে পারে। খাওয়ার সময় বাদাম দাঁতে লাগলে বেশ মজা পাওয়া যায়। দুধ শুকিয়ে গেলে আরেকটু দুধ ঢেলে নিতে হবে। মিশ্রণকে ঘেঁটে মিশিয়ে নিতে হবে। একেক দিন একেক রকম ফলের কম্বিনেশন করা যেতে পারে। এতে করে একঘেয়েমি কেটে যাবে। এটি বেশ স্বাস্থ্যসম্মত একটি খাবার। যাঁদের অ্যাসিডিটি আছে, তাঁদের জন্য খাবারটি বেশ নিরাপদ। আর নাশতা হিসেবে বেশ। অনেকক্ষণ পেটেও থাকে।
ছবি: লেখক ও পেকজেলসডটকম