খাওয়া যায় কাঠও
শেয়ার করুন
ফলো করুন

খাদ্য ও কাঠ, এ দুটির সম্পর্ক আদিকালের। যখন খাদ্য ও কাঠ নিয়ে বলা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবার চিন্তায় আসে জ্বালানি কাঠের ব্যবহারে তৈরি খাবারের কথা। গ্যাসের চুলা রান্নাঘর দখল করার আগপর্যন্ত কাঠ ছিল রান্নার অন্যতম প্রধান জ্বালানি। এখনো কিন্তু রান্নায় কাঠের ব্যবহার থেমে নেই। উড ফায়ার পিৎজা বা সিডার প্ল্যাঙ্কে (তক্তা) রান্না করা স্যামন মাছ অথবা মাটির চুলায় কাঠ ব্যবহারে তৈরি মাংসের কাবাবের কথাই ধরুন। এগুলোর কথা চিন্তা করলে জিবে জল চলে আসবেই। তবে আর যাহোক আমরা কেউ কখনো কাঠ খাওয়ার কথা ভাবতেও পারব না। কিন্তু জানেন কি, এখন নাকি কাঠ খাওয়াও যায়!

আকারাতিয়া গাছ
আকারাতিয়া গাছ

অদ্ভুত শোনালেও ব্যাপারটি কিন্তু সত্যি। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে মলিকুলার গ্যাস্ট্রনমি। এই প্রক্রিয়ায় রান্নায় রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যবহার করে খাবারের স্বাদ ও টেক্সচারের পরিবর্তন করা হয়।

বিজ্ঞাপন

কাঠ ও বাকলে প্রচুর ফাইবার থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের হজমযোগ্য নয়। তবে এমন একটি গাছ আছে, যার কাঠ শুধু খাওয়ার যোগ্যই নয়, রীতিমতো সুস্বাদুও। গাছটির নাম আকারাতিয়া। গাছটি শুধু আর্জেন্টিনাতে জন্মে। আকারাতিয়া গাছ প্রায় ১৫ মিটার (৫০ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এবং এই গাছের মূল কাণ্ড খাওয়া হয়। এই ভোজ্য কাঠ তক্তা, মিহি গুঁড়া বা তুষ এবং ছোট ছোট চারকোনা পিসে পাওয়া যায়। এটি সিরাপ বা মধুতে ভিজিয়ে রাখা থাকে। এ ছাড়া এখন এই কাঠের স্বাদের জ্যাম ও চকলেট বনবন পাওয়া যায়।

আর্জেন্টাইন টপ শেফ ফার্নান্দো রিভারোলা
আর্জেন্টাইন টপ শেফ ফার্নান্দো রিভারোলা


বর্তমানে আধুনিক আর্জেন্টাইন কুজিনে আকারাতিয়া কাঠ একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। যেহেতু এই দেশ ছাড়া আর কোথাও এই গাছ জন্মায় না, তাই খুব সহজে এটি সেই দেশের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। অনেক নামীদামি আর্জেন্টাইন রেস্টুরেন্টে সুস্বাদু পদ তৈরিতে এই কাঠ ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হচ্ছেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রন্ধনশিল্পী ফার্নান্দো রিভারোলা। আর্জেন্টিনার টপ শেফ মলিকুলার গ্যাস্ট্রনমিস্ট রিভারোলা প্রথম তাঁর রেস্টুরেন্ট এল বাকিনোর মেনুতে এই ভোজ্য কাঠ যুক্ত করেন।

বিজ্ঞাপন

বুয়েনেস এইরেসে অবস্থিত তাঁর রেস্টুরেন্টের অনেক পদে বিশেষ করে ডেজার্ট আইটেমে তিনি ব্যবহার করছেন আকারাতিয়া কাঠ। কারণ, এই ভোজ্য কাঠের স্পঞ্জের মতো টেক্সচার ও প্রাকৃতিক মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে সিরাপের মিষ্টতা জোড় বেঁধে অসাধারণ ডেজার্ট কম্বিনেশন তৈরির ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে আইসক্রিম, জ্যাম তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে এই কাঠ। তবে বর্তমানে কিছু শেফ ঝাল খাবার তৈরিতে আকারাতিয়া কাঠ ব্যবহার করছেন।

চিনির সিরাপে ডুবানো আকারাতিয়া কাঠ
চিনির সিরাপে ডুবানো আকারাতিয়া কাঠ

স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে এই কাঠের স্বাদ নিয়ে কৌতূহল জন্মাতে পারে। নরম, চিউয়ি টেক্সচারের এই কাঠের স্বাদ অনেকটা মিষ্টি আলু বা মিষ্টি কুমড়ার মতো, তবে সেটা সিরাপ বা মধুতে ভেজানো। কোনো বাঙালি প্রথম দেখায় আমসত্ত্ব বলে ভুল করলে দোষের কিছু হবে না। পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে অন্য যেকোনো সবজি বা ফলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এটি ফাইবারের দুর্দান্ত উৎস। এ ছাড়া এতে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান।

আকারাতিয়া গাছ আর্জেন্টিনার পারানা জঙ্গলের ভেতরে লম্বা পাইনগাছ দ্বারা সুরক্ষিত বিশেষ বনভূমি অঞ্চলে জন্মে থাকে। এই সব অঞ্চলে অবস্থিত আদিবাসীদের উত্তরসূরিরা আগে থেকেই গাছটির ভেষজ গুণাবলি সম্পর্কে জানতেন। তাই শরীরের আর্দ্রতা বজার রাখতে ও স্বাস্থ্য ধরে রাখতে তাঁরা এই গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করতেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে এই এলাকায় ঘুরতে গিয়ে প্রকৌশলী পাস্কুটি প্রথমে খেয়াল করলেন যে একমাত্র আকারাতিয়া গাছ কোনোকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং কাগজ তৈরির জন্য বন উজাড় করার পর এই গাছ ফেলে দেওয়া হয়।

আকারাতিয়া গাছের কাঠ
আকারাতিয়া গাছের কাঠ

এরপর তিনি এই গাছের কাঠ খাদ্যোপযোগী করার লক্ষ্যে একটি গবেষণা প্রজেক্ট শুরু করেন। তাঁর এই গবেষণা ভোজ্য কাঠ উৎপাদনের পেটেন্ট পায় এবং পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভোজ্য কাঠের বাণিজ্যিকীকরণের জন্য একটি কোম্পানি গঠন করেন, যার নাম আকারাতিয়া ডেলিকাতাসেন।

আকারাতিয়া ডেলিকাতাসেনেরর ডেজার্ট আইটেম
আকারাতিয়া ডেলিকাতাসেনেরর ডেজার্ট আইটেম

গাছের কাঠকে ভোজ্য করে তোলার ধারণা খাদ্য বা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় নতুন নয়। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা খাদ্যসংকট নিরসনের জন্য গাছ এবং গাছের ছালকে খাদ্যোপযোগী করার জন্য উপায় সন্ধান করছেন। কিন্তু সাধারণ গাছে পাওয়া সেলুলোজ মানুষের হজমযোগ্য নয়। আকারাতিয়াগাছ সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই গাছের কোষ পানি এবং খনিজ উপাদানের আধার। অন্যান্য গাছের কাঠের চেয়ে এতে সেলুলোজের পরিমাণ অনেক কম। সাধারণত একটি পূর্ণাঙ্গ গাছে সেলুলোজ থাকে ৩৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সেখানে আকারাতিয়া গাছে সেলুলোজ মাত্র ১০ শতাংশ।

এ ছাড়া কোষের কম ঘনত্বের জন্য এটি সহজে প্রচুর সুক্রোজ ও গ্লুকোজ শোষণ করতে পারে। এতে লিগনিন কম থাকার কারণে সুক্রোজ বা গ্লুকোজ শোষণ করে নরম স্পঞ্জের মতো আকার ধারণ করে। খাদ্যোপযোগী করার জন্য প্রথমে গাছটিকে কেটে তিন থেকে চার ফুটের তক্তা করে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। বড় পাত্রে করে তিনবার স্টিম করা হয় এর ভেতরকার অ্যাসিড অপসারণের জন্য।

আকারাতিয়া কাঠের তৈরি ডেজার্ট
আকারাতিয়া কাঠের তৈরি ডেজার্ট

এরপর কাঠের তক্তাগুলোকে উচ্চ তাপমাত্রায় তিনবার রান্না বা সিদ্ধ করা হয়। এতে কাঠের কোষগুলো দুর্বল হয়ে। একদম শেষে এতে মেশানো হয় পেকটিন, গ্লুকোজ ও সুক্রোজ। ফলে কাঠের ভেতর থেকে পানি নিঃসরিত হয়। পাশাপাশি সুন্দর রং ও টেক্সচার তৈরি হয়। বিশ্বের বিখ্যাত এবং মেধাবী কুলিনারি এক্সপার্টরা এই কাঠের অনন্য বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বানাচ্ছেন অসাধারণ সব সুস্বাদু পদ।

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১৪: ০০
বিজ্ঞাপন