দুবেলা ডাল-ভাতে না হয় পেট ভরল। খুচরো খিদে আর আড্ডার সঙ্গী হিসেবে স্ন্যাকস না হলে কি চলে? স্ন্যাকস কথাটি শুনলেই বিদেশি ভাইব এলে কী হবে, বাঙালির জাতীয় স্ন্যাকস কিন্তু সেই ভাতেরই মচমচে তুতো ভাই। নিন্দুকেরা যতই তুচ্ছ করে মুড়ি খাওয়ার কথা বলুক, মুড়িবিলাসেই বাঙালিয়ানার পরিচয়।
মুড়ি ভাজার মনোহর জাদুময় দৃশ্য আজকাল ইউটিউব ভিডিওতেই বেশি দেখা হয়। তবে মোড়া পেতে পাশে বসলে রন্ধনশিল্পীর নিপুণ হাতের জাদু দেখার সঙ্গে সঙ্গে মিলবে জিবে জল আনা সদ্য ভাজা মুড়ির অনির্বচনীয় সুঘ্রাণ। লবণজলে সঠিক সময় ধরে ভেজানো চাল একেবারে সঠিক সময় অবধি শুকনা খোলায় টেলে নিয়ে ঢেলে দেওয়া হয় গনগনে গরম বালু ভরা হাঁড়িতে। শলার ঝাড়ুর মতো এক বস্তু দিয়ে বিশেষ মুনশিয়ানায় চক্রাকারে নাড়তে নাড়তেই চাল মুড়ি হয়ে যায়। কেউবা নুছনি হাতে হাঁড়ি নাচিয়েই এ কারসাজি দেখান। এরপর বালু চেলে শুকনা সুতি কাপড়ে মুছে নিয়ে গরম-গরম মুখগহবরে চালান করে দেওয়া যায় মুঠো করে। ঠান্ডা করে টিনের জেরে ভরে রেখে দেওয়া হয় বছরজুড়ে খাওয়ার জন্য।
মুড়ি কিন্তু ভাতের চেয়েও সর্বজনীন। আম-কাঁঠালের সঙ্গেই হোক আর কোরবানির ঝুরা মাংস, গুড়-বাতাসা দিয়ে হোক আর খোলায় টালা কলাই-মটর, মুড়ির চেয়ে ভালো সংগত আর কিছুই দিতে পারে না। আবহমান বাংলায় এই খাবারগুলো যেন শৈশব, মাটি আর দিগন্তজোড়া ফসলের খেতের পরতে পরতে লেখা হয়ে আছে। কোঁচড় ভরা মুড়ি একসময় লম্বা পদব্রজে-নৌকায় যাত্রার সঙ্গী হতো।
বন্যা-বাদলায় এ মুড়িই ছিল ভরসা। এখনো দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলে শুকনা খাবার হিসেবেই মুড়িই নেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। অপেক্ষাকৃত সুলভে দুমুঠো মুড়ি কত শত মানুষের নিদারুণ দারিদ্র্য আর ক্ষুধার সঙ্গী হচ্ছে, সে হিসাব আসলে নেই কোথাও। কুয়াশা জড়ানো বা বৃষ্টিভরা সকালে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের সঙ্গে দুমুঠো মুড়ি হলে আর কী লাগে? চায়ে চিনির বদলে খেজুর গুড় দিলে রসায়নটি জমবে আরও বেশি।
শহর-গ্রামনির্বিশেষে সাঁঝের আড্ডায়, খেলা শেষে পড়তে বসার আগে অথবা অফিস ফেরত ক্লান্তি দূর করতে শর্ষের তেল, পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের কুচি দিয়ে মাখা মুড়ির কোনো তুলনাই হয় না৷ সঙ্গে চানাচুর হলে তো রাজযোটক।
আবার পথখাবার হিসেবে মুড়ি মাখার রয়েছে এক বিশাল ভুবন। ক্ল্যাসিক মসলা-তেল, ছোলা-ঘুগনির পাশাপাশি আজকাল ভাইরাল সব ফুড ব্লগিং ভিডিওতে দেখা যায়, মুরগি-গরু-খাসির মাংস, ডিম, কলিজা-গুর্দা আর তুমুল ঝাল বোম্বাই মরিচের কারসাজিতে নানা কায়দায় বানানো ঝালমুড়ি। রোজার দিনে আবার এই মুড়ি মাখা পায় অন্য মাত্রা।
আমাদের ইফতারে প্রধান খাবারই মুড়ি। ঘরে ঘরে তো বটেই, ধনী-গরিবনির্বিশেষে রাস্তার ধারে, মসজিদের মেঝেতে বা আঙিনায় বসে একই পাত্র থেকে নিয়ে মুড়িমাখা খাওয়ার দৃশ্যটি সম্প্রীতির অন্য রকম দ্যোতনা তৈরি করে। তবে পরক্ষণেই বিবাদ শুরু হয়ে যায় পাঁচমিশালি এ মুড়ি মাখায় জিলাপি পড়বে নাকি পড়বে না তা নিয়ে।
মুড়ি কিন্তু শুধুই আমাদের নয়। ভারতে চাট বা স্ন্যাকস হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু তা ভেল নামে। আমেরিকা ও বিলাতে রাইস ক্রিস্পি সবার প্রিয়। কিন্তু তা কর্ণ সিরাপ বা চিনির সিরা মাখিয়ে চৌকোনা আকার দিয়ে। ঠিক আমাদের গুড়-মুড়ির মোয়ার মতো। আবার আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলের মুড়িপ্রেমীরা বাসী তরকারি আর বিরিয়ানির সঙ্গে মুড়ি ছড়িয়ে খেতে ভালোবাসেন। পায়েস, দই বা হালিমের সঙ্গে খেলেই-বা বারণ করছে কে! মুড়ি তো সবার। মুড়িবিলাসেই বাঙালির পরিচয়।
ছবি: শামীমা মজুমদার