শীতের তরি-তরকারি ফুরিয়ে এসেছে। এদিকে পটোল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স আর ডাঁটার মতো গরমকালের সবজির দাম বেশ বাড়তি। আর আগের দিনে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হতো না বলে শীতের শেষে এমন দিনে সবজি অত বেশি মিলতও না। সেই পুরোনো প্রবাদের মতো ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ অর্থাৎ কলাগাছের ভেতরের থোড় বা খাদ্যযোগ্য অংশ, বড়ি আর সজনে দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ তরকারি, সে চচ্চড়ি করা হতো ঘরে ঘরে। সংগত দিত রোজকার আলু-বেগুন। তবে এর মধ্যে বিশেষ করে বড়ির কথা বলতে হয় সাশ্রয়ী অথচ অত্যন্ত উচ্চমানের আমিষের উৎস হিসেবে।
বড়ির প্রধান উপকরণ মাষকলাইয়ের ডাল। সঙ্গে দেওয়া হয় মিহি করে বেটে নেওয়া পুষ্ট চালকুমড়া। পছন্দ অনুযায়ী কেউ কেউ যোগ করেন কালিজিরা, পাঁচফোড়নের গুঁড়া বা পোস্ত। মাষকলাইয়ের ডাল বাটলে এমনিতেই আঠালো ভাব বেশি হয়। তবে চালকুমড়া এ ক্ষেত্রে শুকানোর পর বড়ির ফুরফুরে টেকশ্চার ও অনন্য স্বাদ দেয়।
বাইন্ডিং এজেন্ট হিসেবেও আসে এর ভূমিকার কথা। এবারে এই ডালের মণ্ড সঠিকভাবে ফেটিয়ে নেওয়ার পালা। পরিষ্কার ও শুকনা হাতে ফেটাতে হয় বড়ির মণ্ড সময় নিয়ে। একসময় ফুলে–ফেঁপে ওঠে মণ্ডটি অভিজ্ঞ হাতের ঘূর্ণিতে। তবে এ মণ্ডে বাতাসের বুদ্বুদ থাকলেই ঘটবে বিপত্তি। একে কালিনারি ডিকশনারিতে এয়ারেশন করা বলা হয়, যা বড়ির চিরচেনা টেকশ্চারটি দেয়। ঐতিহ্যগতভাবে নতুন শাড়িতে বড়ি রোদে দেওয়ার কারণটিও কিন্তু খুবই বৈজ্ঞানিক। রোগ–জীবাণুর অনুপ্রবেশ বা ছাতা পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের পূর্বশর্তই হলো পরিষ্কার কাপড়ে বড়ি দেওয়া। শীতের শেষের দিকেই কাজটি অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই মিলে করা হয় প্রধানত দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে।
সাধারণ আকারের বড়ির পাশাপাশি নকশাদার ফুলবড়ি ও গয়নাবড়িতে হাতের কাজের দারুণ নৈপুণ্য ফুটে ওঠে। কোথাও কোথাও পেঁয়াজসহযোগেও এমন বড়ি বানানো হয়, ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রকমের ডাল। তবে চালকুমড়া দিয়ে বানানো মাসকলাইয়ের ডালের বড়িই বেশি জনপ্রিয়। এমন দিনে রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে বায়ুরোধী বয়াম বা কৌটায় সংরক্ষণ করে বড়ি খাওয়া যায় সারা বছর। বেগুন-বড়ির তরকারি, মাছ ও সবজি দিয়ে বড়ির ঝোল, বড়ি ভেঙে শাকের ঘণ্ট, বরইয়ের টকে ভাজা বড়ি, টালা বড়ির ভর্তা—জিবে জল আনা সব পদের যেন শেষ নেই।
মাসকলাইয়ের ডালে অন্যান্য অনেক ডালের তুলনায় আমিষ, আয়রন ও ক্যালসিয়াম বেশি। তাই পুষ্টিগুণেও বড়ি অনন্য। তবে মাষকলাই ডালে ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকায় বাতের রোগী ও কিডনি সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তির জন্য বড়ি কতটুকু খাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
তথ্যসূত্র : হেলথলাইন ও কেমন করে এল ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’- রজত কান্তি রায় (প্রথম আলো)