দেশি হার্বসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বজনীন বলা যায় ধনেপাতাকে। সবজির বাজারে আর ফেরিওয়ালার ভ্যান বা টুকরিতে সবুজ সতেজ ধনেপাতা দেখে না নিয়ে পারা যায় না। তবে এর ব্যবহার এত বিচিত্র আর বহুমুখী যে পরদিনই আবার দৌড়াতে হয় ধনেপাতা কিনতে।
কড়কড়ে করে ভাজা মাছ আর সঙ্গে মিহি করে বাটা ধনেপাতার ভর্তা। মজার এই যুগল গরম ভাতের পাতে এই দিনে খুবই সমাদৃত। ধনেপাতার ভর্তায় মাখা সবুজ ভাতের গ্রাসের সঙ্গে এতে দেওয়া রসুন-কাঁচামরিচের ঝাঁজ ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকে। মিহি করে কুচিয়ে শর্ষের তেল, পেঁয়াজকুচি আর কাঁচামরিচকুচির সঙ্গে বেশ করে হাতে মেখে নিলেও দারুণ হয় ধনেপাতা। আর এই মিশ্রণের সঙ্গে টালা চিংড়ি, আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, টেলে বা সেদ্ধ করে নেওয়া টমেটো, পোড়া বেগুন বা যেকোনো সবজি ভাতে মেখে নিলে ভর্তার মেলা বসবে। একইভাবে টেলে নেওয়া শুঁটকি, চ্যাপা, হিদল দিয়েও এ রকম হাতে মাখা ভর্তা করা যায় ধনেপাতার ফ্লেভারে।
লাউ-চিংড়ি বা বিভিন্ন রকমের সবজির পদ, মাছের ঝোল তরকারি, বিভিন্ন রকমের চচ্চড়ি অসম্পূর্ণ রয়ে যায় শেষে ধনেপাতাকুচি না ছড়িয়ে দিলে। উদার হস্তে ধনেপাতাকুচি ব্যবহার হয় ঘন্ট বা ডালেও। দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে হায়দরাবাদি ঘরানার পদে আবার মসলা কষাতেও ধনেপাতা দিয়ে দেওয়া হয়। হায়দরাবাদি বিরিয়ানির ফ্লেভারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এভাবে ব্যবহার করা ধনেপাতা।
উত্তর ভারতে মাংসের হরিয়ালি কাবাব আর সবুজ গ্রেভির মাখা পদের চোখজুড়ানো রঙে অবদান রাখে ধনেপাতা। থাই গ্রিন কারির জন্যও এ কথা সত্য। তবে থাই হেঁশেলে সুপ, স্টার ফ্রাই কিংবা কারি রান্না করতে ধনেপাতার ডাঁটা বেশি ব্যবহার হয়। এতে ফ্লেভার বেশি মেলে।
মেক্সিকান এনচিলাদা, তাকো ইত্যাদি পদে পরিবেশনের আগে ধনেপাতা দেওয়া হয় বেশ পরিমাণে। তবে শুধু দক্ষিণ আমেরিকা আর মেক্সিকো নয়, এর স্বাদে মজেছে এখন গোটা মার্কিন মুলুক। সিলান্ট্রো নামে বেশি পরিচিত ধনেপাতা সেখানে। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কুইজিনেও অন্যান্য হার্বসের পাশাপাশি ধনেপাতার ব্যবহার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী ‘যুউগ’ নামের সসটির মূল উপাদানই ধনেপাতা।
তবে আমাদের পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই ধনেপাতা এক অন্য রকম ভালোবাসার নাম। ধনেপাতার চাটনি যেমন রসনায় বান ডাকে, তেমনি যেকোনো ফল বা মুড়িমাখা, চানাচুরমাখা, ভারতের জনপ্রিয় সব চাট আর নোনতা স্ন্যাকসের প্রাণ এই ধনেপাতার ফ্লেভার। শিল-পাটায় ছ্যাঁচা বরই, ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ, সঙ্গে একটু নুন আর আখের গুড়—জিবে জল এসে গেছে আলবাত সবারই এ বর্ণনা পড়তে গিয়েই।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের একশ্রেণির মানুষ যেন ধনেপাতার নাম-গন্ধও সইতে পারে না। বিশ্বের বাঘা বাঘা জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। কারও কারও মস্তিষ্কের রিসেপটর ধনেপাতার সুবাসকে বিকট গন্ধ বলে সিগনাল দেয় নাসিকারন্ধ্রের কাছে এলেই। ব্যাপারটি নাকি কিছুটা বংশগতও, বলেন বিজ্ঞানীরা। আর তাই বিশ্বের এক অংশ মানুষ ধনেপাতা অত্যন্ত ভালোবাসে আর এক অংশ ধনেপাতা দেখলেই উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে।
তথ্যসূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন, ফুড নেটওয়ার্ক, ফ্লেভার জার্নাল, হাডসন আলফা ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি