তুরস্কের রান্নাঘর পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ রন্ধন ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেমন চীনা, ভারতীয় বা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি তুর্কি খাবারের রেস্তোরাঁও বিভিন্ন স্থানে সৌরভ ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে তুর্কি খাবারের প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উত্তপ্ত কয়লার আঁচে শিকে গাঁথা নানা রকম কাবাব ও ডোনারের মোহনীয় ছবি।
অথচ তুরস্কের প্রতিটি অঞ্চল নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতি বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। এখানে এমন পাঁচটি পদ নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলোর সঙ্গে পরিচয় বাইরের দুনিয়ায় হয়তো সেভাবে নেই। অথচ তুরস্ক ভ্রমণে এই পঞ্চপদ না খেলে জীবন বোধ করি ষোলো আনাই মিছে হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।
প্রথম দর্শনে কাটমারকে যেন মোগলাই পরোটার ছোট ভাই মনে হয়। যদিও মোগলাই পরোটার সেই মচমচে ভাবটি কাটমারে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাদের দিক থেকেও এ দুইয়ের মধ্যে আছে স্পষ্ট ভিন্নতা। মোগলাই পরোটার মতো কোনো ঝাল-মসলাদার খাদ্য নয় কাটমার; বরং এটি এক ধরনের সুস্বাদু পেস্ট্রি হিসেবে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছে। খামিরকে বেলে পাতলা করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি হয় কাটমার। বাকলাভা বা কুনাফার ব্যপক জনপ্রিয়তার ভিড়ে কাটমারের নাম সেভাবে উচ্চারিত হয় না। তবু এর সৌন্দর্য ও স্বাদে মাধুর্যময়।
প্রথমে ময়দাকে অতি পাতলা করে টেনে নেওয়া হয়, তারপর প্রতিটি স্তরে ঘি বা মাখনের প্রলেপ দেওয়া হয়। ভেতরে ভরা হয় পেস্তা, হ্যাজেলনাট কিংবা ক্লটেড ক্রিম—যাকে বলে ‘কায়মাক’; এভাবে একের পর এক স্তর সাজিয়ে তার উপরিভাগে ছড়িয়ে দেওয়া হয় চিনির মিষ্টি আবরণ। তারপর ওভেনের উত্তাপে বেক করে নেওয়া হয়। গরম–গরম পরিবেশনের সময় এর বাইরের মুচমুচে স্তর আর ভেতরের মোলায়েম ও মিষ্টি অংশ এক অপূর্ব স্বাদের সম্মিলন ঘটায়, যা জিবে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। পরিবেশনের মুহূর্তে অনেক সময় কাটমারের উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় পেস্তার সবুজ গুঁড়া; যা এর সৌন্দর্য ও স্বাদে যোগ করে আলাদা মাত্রা। অনেকে একে চায়ের সঙ্গী করেন।
তুরস্কের খাদ্যসংস্কৃতি যেন এক গভীর সমুদ্র, যার তলদেশে লুকিয়ে আছে ঐতিহ্যের অমূল্য রত্ন। ছয় মাস তুরস্কে কাটিয়েও দেশটির অনেক খাবারের স্বাদ গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়নি। এই স্বাদযাত্রা বলতে গেলে অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তবে তুর্কিদের আতিথেয়তা থেকে গেছে অনিন্দ্য স্মৃতি হয়ে। অবকাঠামোগত দিক থেকেও তুরস্ক ইউরোপের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, যা এর সমৃদ্ধি অনন্যতার পরিচয় বহন করে।
আমাদের দেশের মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা মসলা ছাড়া খাবারের কথা কল্পনাও করতে পারি না। কোনো খাবারের সঙ্গে আমাদের রুচির অমিল হলে সেটা গ্রহণ করতে আমাদের মন সায় দেয় না। এই প্রবণতার কারণে বিদেশে গিয়েও আমরা সে দেশের খাবারের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন থেকে বিরত থাকি কিংবা ব্যর্থ হই। অথচ খাবার তো কেবল পেট ভরানোর উপায় নয়; এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কোনো দেশ ভ্রমণের সময় সেই দেশের খাদ্যকৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা না নেওয়া যায়, সেই দেশের স্বাদের সঙ্গে পরিচয় না ঘটে, তবে সে ভ্রমণ তো বৃথাই। তাই প্রতিটি নতুন দেশে পা রাখার সঙ্গে সে দেশের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা উচিত বলেই আমার মনে হয়। কেননা, সেই আস্বাদেই লুকিয়ে থাকে সে দেশের হৃদ্স্পন্দন।
ছবি: লেখক, উইকিমিডিয়াকমনস ও পেকজেলসডটকম