শুকনা মরিচের ঝালে লাল হয়ে ওঠা আলুভর্তা দিয়ে পান্তাভাত খেয়ে পয়লা বৈশাখের সকালে অনেকেই বাঙালি খাবারে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। তাঁদের সেই ঢেকুর গলাতেই আটকে যাবে, যদি বলা হয়, আলু বা মরিচ আদতেই বাংলার আঞ্চলিক শস্য নয়। এমনকি এই এশিয়া মহাদেশেরও নয়! চৈত্রের গরমে ফালি করে কাটা আনারস যেন অমৃত, প্রবল দেশাত্মবোধের কাছে সেই অমৃতেও অরুচি আসতে পারে যদি জানানো হয় আনারসও ভিনদেশি। শিঙাড়ার নাকি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার ওডিশার এক পাচকের আবিষ্কার, তবে শিঙাড়ায় যে টমেটো সস মাখিয়ে স্বাদ বাড়িয়ে নেওয়া হয়, সেই টমেটো এসেছে সুদূর মেক্সিকো থেকে।
এসব শস্য, ফল বা সবজি কী করে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে গঙ্গাপারের বদ্বীপে এল, তার পেছনে আছে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ অনেক কিছু। যার খানিকটা বাস্তব আর খানিকটা কল্পনা; কিংবা বলা চলে, বাস্তবের ফাঁক ভরতে কল্পনার আশ্রয়ের চেষ্টা। ঠিক কবে ও কার হাত ধরে কোন পথে কোন খাদ্য উপকরণ বাঙালি হেঁশেলে ঢুকে পড়েছে, তার ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করা কঠিন। তবে বিদেশি এসব শস্য, ফল ও সবজিকে বাঙালি আপন করে নিয়েছে পরম মমতায়, সাজিয়েছে নিজের মতো, আর মাত্রা দিয়েছে নিজস্ব রসনায়।
আলু, টমেটো, ভুট্টা, মিষ্টি আলু, পেঁপে, আনারসসহ অনেক রকম ফল ও সবজি আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ছোট্ট একটা ভুলের কারণে। ভারত আবিষ্কারের বদলে কলম্বাস পা রেখেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে, সেখান থেকে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। বাকি পৃথিবীর বাসিন্দাদের কাছে আমেরিকা মহাদেশ ছিল ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’। কলম্বাস ও তাঁর নাবিকেরা এরপর গেছেন নানান দ্বীপ আর দেশে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন পুরান দুনিয়ার অনেক অসুখ, আর নিয়ে এসেছেন অনেক নতুন শস্য।
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কারণেই পুরান আর নয়া দুনিয়ার মধ্যে যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়, তারই পথ ধরে অনেক কিছুরই অদলবদল হয়েছে। ১৯৭২ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ আলফ্রেড ডব্লিউ ক্রসবি একটি বই লেখেন। নাম ‘দ্য কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ’।
এর পর থেকে তাত্ত্বিক, সাংবাদিক সবাই শব্দটি লুফে নেন। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বাইরে অচেনা থাকা এই জগতের অনেক কিছুই পরে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সেই সঙ্গে ইউরোপ থেকে খ্রিষ্টধর্ম আর উপনিবেশবাদও গিয়েছে মায়া সভ্যতা আর আজটেকদের মন্দিরে। এককথায় এই অদলবদলের কেতাবি নাম কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ।
দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা থেকে স্প্যানিশদের হাত ধরে আলু, টমেটো, ভুট্টা, মিষ্টি আলু, পেঁপে, আনারসসহ অনেক কিছুই আসে ইউরোপে। সেখান থেকে পর্তুগিজদের হাত ধরে চলে আসে ভারতবর্ষে। এখানকার উর্বর মাটি আপন করে নেয় মধ্য আমেরিকার অতিথিদের।