সর নিয়ে লিখতে গেলে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। গ্রাম বা মফস্বলে বড় হওয়া যে কারোর জন্য এ এক স্মৃতিমেদুর করা অনুপান। কারণ, দুধের সর চুরি করে খাওয়া ছিল যেন ছেলেবেলার অবশ্যকর্তব্য। আবার ধরা পড়ার বিষয়ও যে ছিল না, তা নয়। তবু সর খাওয়াটা ছিল অত্যাবশ্যক। আবার দুধের হাঁড়ির নিচে জমে থাকা সর কে খাবে, তা নিয়েও বেশ একটা প্রতিযোগিতা চলত। একান্নবর্তী পরিবারে এ ক্ষেত্রে কিছুটা পক্ষপাতও থাকত না, তা নয়। এ ক্ষেত্রে দাদি, নানি, বড়মা, অর্থাৎ গৃহকর্ত্রীর পছন্দের কেউ কোনো কোনো সপ্তাহে একটু বেশিই পেতেন। সেই সর চামচ দিয়ে চেঁচে তাতে মুড়ি আর চিনি মিশিয়ে খাওয়ার স্মৃতি এই লেখা পড়তে পড়তে অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে যেতে পারে। ঠিক যেভাবে বর্ণনা করছিলেন ডিজাইনার ও গবেষক চন্দ্র শেখর সাহা।
তবে সর প্রসঙ্গে আমার এক সাবেক সহকর্মীর কথা বেশ মনে পড়ে। অফিসে ঢুকে তিনি কারও প্রশংসা শুনলেই জোরে বলে উঠতেন, ‘আরে মালাই মারকে’। তিনি থাকতেন পুরান ঢাকায়। ফলে মালাই (ঢাকাইয়া উচ্চারণে মলাই) নিয়ে তাঁর আদিখ্যেতা থাকা বাহুল্য নয়। বরং এখনো তাঁদের কাছে মালাই বা মলাই আভিজাত্যের প্রতীক।
পুরান ঢাকার ভূমিকন্যা শায়লা পারভীন। পারিবারিক আবহ আর জীবনভর দেখা মিলিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার বেশ ঋদ্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর ঢাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা গবেষণা। তিনি বললেন, পুরান ঢাকার মানুষের শৌখিন খাবার হলো মালাই। তাঁদের ভাষায় এক থাল মালাই। তাঁরা চায়ের সঙ্গে তো খাবেনই, এমনকি মালাই চিনি দিয়েও খাবেন। কেউ আবার আমের সময় আম আর মালাই মেখে ফ্রিজে রেখে দিয়ে পরে মুড়ি দিয়ে খেয়ে থাকেন। তাঁর বড় জাকে তিনি এভাবেই মালাই খেতে দেখেছেন।
আর পিঠাপুলিতে তো থাকতেই হবে। পাটিসাপটার ভেতরে থাকবে মালাই, থাকবে মোরগ–পোলাও, রেজালা, শাহি টুকরা, জর্দায় টপিং হিসেবে। এটাই যেন সরদার বাড়ির আভিজাত্য, বললেন শায়লা পারভীন। সঙ্গে যোগ করলেন কিছুদিন আগের ঘটনা। এক সরদার বাড়ি থেকে তাঁদের পরিবারের জন্য পোলাও, কোর্মাসহ নানা ব্যঞ্জন পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি পদের ওপরে গার্নিশ করা হয়েছে মালাই দিয়ে।
তাঁর দাদিশাশুড়িকে মিছরি দিয়ে মালাই খেতে দেখেছেন, স্মৃতিচারণা করলেন শায়লা পারভীন। তিনি ঢাকার মানুষের রোজকার খাবার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৩০ বছর পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত জোগাতে সক্ষম হয়েছেন। সেই আলোকে বললেন, রোজার সময় সাহ্রিতে চিনি দেওয়া মালাই খাওয়ার চল এখনো বজায় আছে। রোজায় চকবাজারে রাবড়িও পাওয়া যায়, যেটা সরের এক উত্তম আর উপাদেয় পদ।
কথায় কথায় শায়লা জানাতে ভোলেননি পুরান ঢাকার বংশালের হাবুর মালাইয়ের কথা, যার সুনাম এখনো রয়েছে।
তবে ঢাকার বাবুর্চিরা এখনো কোনো বিয়েবাড়ির রান্নার ফর্দে মালাই রেখে দেন। অনেক জায়গায় এই মালাই বিক্রিও করা হয়। আর সেগুলো চলে যায় বাবুর্চিদের কাছে, যেটা তাঁরা ব্যবহার করেন মূলত টপিং বা গার্নিশ হিসেবে।
পুরান ঢাকায় সরকে মালাই বলা হলেও দুটি কিন্তু এক নয়। এখানেও সেই ক্ষার আর ক্ষারক থিওরি বিদ্যমান। সর আসলে ঢিমে আঁচে দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করার পর উপরিভাগে তঞ্চিত বা ঘনীভূত ফ্যাট আর প্রোটিনের পরত। দুধের মানের ওপর নির্ভর করে সরের মান। এর পুরুত্ব। অনেকে আবার এই সরকে ননিও বলে, কিন্তু সেটাও ঠিক নয়।
বরং ত্রয়ীই আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সর আগেই উল্লেখ করেছি দুধের উপরিস্তরে ঘনীভূত ফ্যাট আর প্রোটিনের পরতের কথা। এটা সর নামেই পরিচিত। মালাই হলো সরসহ ঘন দুধের মিশ্রণ। অন্যদিকে কাঁচা দুধকে টেনে যে ঘন পদার্থ পাওয়া যায়, সেটাই ননি। এই টানা বা সেন্ট্রিফিউজ করা আগে হতো হাত ও বাঁশের সাহায্যে। এখন মেশিন পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়া মেশিনেই করা হয়। এই ননিই কিন্তু মাখন। আর ননির কথা উঠলে ননি চোরের কথাও আসে। অনেকটা কান টানলে মাথা আসার মতো। ননি চুরি করে খাওয়ার জন্য মা যশোদা আদর করে কৃষ্ণকে ‘ননি চোর’ বলেছিলেন (যশোদার নয়নে তুমি ননি চোর/নন্দ দুলাল তুমি আনন্দ কিশোর!)।
মাখন ও সর উভয়ই জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ঘি। কেউ বলে, মাখন থেকেই তৈরি হয় সর্বোৎকৃষ্ট ঘি। আবার কারও কাছে সরের ঘি–ই সেরা। সর জাল দিয়ে ঘি তৈরির পর যে অবশিষ্টাংশ বা ক্বাথ থাকে, তাকে ঝুরা বা ঝুরি বলে। সেটা অনেকে তরকারিতে দেয় স্বাদ বাড়ানোর জন্য। অনেকে আবার গরু-ছাগল-মুরগিকেও খাওয়ায়।
মাখন দুইভাবে তৈরি করা যায়। একটা হলো সরাসরি দুধ থেকে, যেটার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আরেকটা হলো দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করা পর রেখে দিলে সেটা দইয়ের অবয়ব নেয়। সেটাই আবার টানলে ননি বা মাখন ওঠে। এ প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট তরলই হলো ঘোল বা বাটারমিল্ক। ঘোল শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী পানীয়। তবে ঘোল তৈরির সময় ননি বেশি উঠিয়ে নিলে ঘোলের ঘনত্ব কমে গিয়ে পাতলা হয়ে যায়। ফলে স্বাদও তেমন হয় না। বর্তমানে মেশিনে টানা হয় বলে ক্রিম বা ননি বেশি উঠে যায়। তাই ঘোলের স্বাদেও হেরফের হয়ে থাকে। এ জন্য এখনো হাতে টানা ঘোলই সেরা। বাঁশের তৈরি যে দণ্ড দিয়ে ঘোল তৈরির জন্য টানা হয়, সেটাকে কোথাও কোথাও ঘোলট বলে।
আমাদের দেশের ননি আর পশ্চিমের ননি বা ক্রিম এক নয়। তাদের ক্রিম সরাসরি শিল্পজাত পণ্য। সেখানে দুধ থেকে মেশিনের মাধ্যমেই ক্রিম তৈরি হয়। ক্রিমের নানা প্রকারভেদ আছে। ক্লটেড ক্রিম, হেভি ক্রিম, হুইপিং ক্রিম, লাইট ক্রিম, শাওয়ার ক্রিম, হাফ অ্যান্ড হাফ ক্রিম ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ মিল্ক ফ্যাট থাকে ক্লটেডে। আর সবচেয়ে কম ১০-১৫ শতাংশ থাকে হাফ অ্যান্ড হাফে।
ক্রিমের সঙ্গে আবার বাতাস মিশিয়ে তাদের ফোমে রূপান্তরিত করা হয়। এই ক্রিম প্যাটিসারিতে কেক, পেস্ট্রি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটা বেশি খাওয়া যায় না। অল্প খেলেই পেট ভরে আসে, বলছিলেন ফ্রান্সপ্রবাসী অণুজীববিজ্ঞানী মইনুল হাসান।
কথা প্রসঙ্গে আরও মজার তথ্য দিলেন তিনি। গরু যে বায়ু ত্যাগ করে, তাতে মিথেন গ্যাস থাকে। সেটা পরিমাণ যথেষ্ট। তাই এ গ্যাস কমানোর জন্য তারা গরুকে একধরনের অ্যাডিডিভ খাওয়াচ্ছে। এর ফল হচ্ছে উল্টো। গরুর দুধে তৈরি মাখনের স্বাদ কমে যাচ্ছে। তাই এখন কানাডিয়ানরা ফরাসি মাখনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
তবে তাঁর দেওয়া মজার তথ্যটি হলো, দুধে থাকে ক্যাজিন নামে একধরনের প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ। এর কারণে আমরা যে রসগোল্লা খাই, তা মজাদার হয়। এই ক্যাজিন দিয়ে দুধের কনটেইনার তৈরি নিয়ে গবেষণা চলছে। সেটা হলে প্যাকেটসহ দুধ জ্বাল দিয়ে খেয়ে ফেলা যাবে বা ওই প্যাকেট তরকারিতে দিয়ে রান্না করেও খাওয়া যাবে। তাহলে কমবে দুধের প্যাকেট তৈরিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার।
যা হোক, ফরাসিরা এখন আস্তে আস্তে উপমহাদেশের ঘি বা ক্লারিফায়েড বাটারের দিকে ঝুঁকছে। তবে মইনুল হাসান জানালেন, ফরাসি সাহিত্যে ক্রিমের উল্লেখ থাক বা না থাক, তাদের রসনাবিলাসে আদিখ্যেতা যে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এদিকে প্রতি জুলাই মাসে উইলম্বলডন টেনিস চলার সময় ক্রিম দিয়ে স্ট্রবেরি খাওয়া কিন্তু ব্রিটিশদের ঐতিহ্য।
ক্রিম প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন রবীন্দ্রনাথই–বা বাদ যাবেন কেন। কারণ তাঁর ক্রিমে বেশ আগ্রহ ছিল। তবে এই ক্রিম পশ্চিমের নাকি দেশের মালাই কিংবা সর, তা জানা সম্ভব নয়। তবে বনফুলের বর্ণনায় ক্রিমের উল্লেখ আছে, ‘ভৃত্য নীলমণি বেশ বড় একটা কাঁসার থালা এনে রবীন্দ্রনাথের সামনে রাখল। থালার ঠিক মাঝখানে একটা রুপার বাটি উপুড় করা। আর তার চারপাশে নানা রকমের কাটা ফল গোল করে সাজানো। কাটা ফলের ফাঁকে ফাঁকে গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব ছড়ানো। প্রাতরাশের এই অদ্ভুত সজ্জা দেখে আমি তো অবাক। বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন রবীন্দ্রনাথ আস্তে করে রুপার বাটিটা তুলে ফেললেন আর তার ভেতর থেকে ওই বাটির মাপের সাদা জমানো একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল। জিনিসটা কী জানতে চাইতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, “ক্রিম। আর এগুলো নানা রকমের ফল, বাদাম, ডাল ভেজানো, খাবে তুমি?” আমি খাইনি। তবে লক্ষ করেছিলাম তাঁর দীর্ঘ প্রাতরাশ।’
সরে ফেরার আগে মালাইয়ের ব্যবহার সম্পর্কে একটু বলে রাখা প্রয়োজন। পুরান ঢাকার আরেক ভূমিকন্যা নাদিমা জাহান জানাচ্ছিলেন, পুরান ঢাকায় দুটি বিশেষ কমিউনিটি আছে। সুব্বাসী বা সুখবাসী আর কুট্টি। মালাই উভয় সম্প্রদায়েরই বেশ প্রিয়। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে মালাই চা, ফালুদা, কুলফি, শাহি টুকরায় মালাই দেয়। মোরগ–পোলাও, খাসির গ্লাসি, রোস্ট, মুর্গমুসাল্লাম, রেজালায়ও ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মালাই কোফতা, চিকেন মালাই টিক্কা, মালাই পনির ইত্যাদি সব বিখ্যাত মালাই ডিশ। মালাই কুলফি, রাবড়ি—এ দুটি ভারত থেকেই এসেছে। আর আমের সময় আম-মালাই খাওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
তবে নাদিমা জাহান বলেছেন, রাবড়ি নামের সর দিয়ে বানানো ডেজার্ট পুরান ঢাকায় খুব জনপ্রিয় বহু আগে থেকেই। রোজার সময়েই বেশি পাওয়া যায়। অনেকে এটাকেই আঞ্চলিকভাবে ‘লাবড়ি- মলাই’ বলে। এই নামে অনেক দোকানে বিক্রিও হয়।
এর বাইরে আরও আছে মিষ্টি। যেমন মালাই চপ, রসমালাই, মালাই দই ইত্যাদি। আর রাবড়িতে মালাই তো থাকেই। কারণ, সরের ফালিগুলো আহ্লাদে আটখানা হয়ে যে অমৃত তরলে সাঁতরে বেড়ায়, তাদের দেহবল্লরিকে আরও মোলায়েম আর লাবণ্যময় করতে সেটা আসলে মালাই বৈ তো অন্য কিছু নয়। তরলে বাড়তি যোগ হয় খেজুরের গুড় বা চিনি। রাবড়ির প্রসঙ্গ যখন এল, তখন উল্লেখ করতেই হয় পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামের কথা। হুগলি জেলার চণ্ডীতলা থানার গাংপুর। এই গ্রামের ৪০টি বাড়ির প্রতিটিতেই তৈরি হয় রাবড়ি। এটা কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে। আর গ্রামের নাম এখন গাংপুর হিসেবে রয়ে গেছে কেবল কাগজে-কলমে। বরং পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘রাবড়ি গ্রাম’ হিসেবে।
তবে রাবড়ি নতুন কোনো মিষ্টি নয়। বরং এর উল্লেখ আমরা পাই সাহিত্যিকদের লেখায়। লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী অমিয়া চৌধুরী নিজের বউভাত নিয়ে যে স্মৃতিচারণা করেছেন, সেখানে উল্লেখ আছে রাবড়ির, ‘...বিয়ের দিন গান্ধীজি হরতাল ডেকেছিলেন, প্রিন্স অব ওয়েলস, অষ্টম এডওয়ার্ডের ভারত আগমন উপলক্ষে। তাই আগের দিন বড় বড় রুই মাছ ও গলদা চিংড়ি এনে বরফ দিয়ে বাক্সে প্যাক করে রাখা হয়। হাঁড়ি হাঁড়ি দই এবং রাবড়িও ছিল।’
আবার লেখিকা শরৎকুমারী চৌধুরানী সেকালে বনেদি পরিবারের বিয়ের ভোজের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন রাবড়ির কথা, ‘...রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রুইয়ের মুড়া দিয়ে মুগের ডাল, আলুর দম ও ছক্কা। মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট। ভাজা ইলিশ, বেগুনভাজা, শাকভাজা, পটলভাজা, দই, মাছ আর চাটনি। তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপড়ভাজা। মিষ্টান্নের একখানি সরায় আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ। ইহার ওপর ক্ষীর, দই, রাবড়ি ও ছানার পায়েস।’
লীলা মজুমদার তাঁর নিজের বিয়ের ভোজ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন রাবড়ির কথা, ‘বিয়ের রাতে সাড়ে সাত শ লোক চিংড়ি মাছের মালাইকারি, রাবড়ি ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস খেয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।’
ফেরা যাক সর প্রসঙ্গে। ১৯৩৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর কবি সুবিমল বসাক লিখছেন একটি বিয়ের গীত। সেখানে মেয়েকে সর বিশেষণ দেওয়া হচ্ছে, ‘ম্যায়া আমার দুধের সর/কেমতে লো ম্যায়া করবি পরের ঘর।’
কেমন করে সে পরের ঘর করে, সেটা না হয় নাইবা জানা গেলো, তবে সর দিয়ে কি মিষ্টি তৈরি হয়, সেটা অন্তত জানা যেতে পারে। প্রথমে উল্লেখ করতে হয় সরভাজার কথা। শ্রী যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস–এর প্রথম খণ্ডে এর উল্লেখ আছে। বিক্রমপুরে এখনো পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন আমার এক সহকর্মী। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কৃষ্ণনগরের তিনটি বিখ্যাত মিষ্টি হলো সরভাজা, সরপুরিয়া আর রসাসর। তিনটি মিষ্টি নিয়েই নানা গল্প চালু আছে। তবে বলা হয়ে থাকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষণায় এই মিষ্টান্ন ত্রয়ী বাঙালির রসনাবিলাসে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সিনেমা ও সাহিত্যেও এরা জায়গা করে নিয়েছে। জগদ্ধাত্রী পূজার সঙ্গে মিষ্টির সম্পর্ক আছে। আর কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা মানেই সরভাজা। একটা কথা চালু রয়েছে, ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে খুব গোপনে সরভাজার জন্য পাক তৈরি হতো।
দই জমলে ওপরের দিকে যে পরত বা আস্তরণ পড়ে, সেটাও সর। একে দইয়ের মাথাও বলে। তবে ইদানীং সরের দই বলে একধরনের দইয়ের প্রচলন ঘটেছে। এটা আসলে দই পাতার একটা কৌশল। আগে মাটির পাত্র নির্দিষ্ট তাপে গরম করে নিয়ে সেটাকে উনুনের পাশে রেখে আস্তে আস্তে দুধের দ্রবণ ঢালতে হয়। প্রথমবার ঢেলে কিছুটা বিরতি দিলে দই দ্রুত জমে গিয়ে ওপরে আস্তরণ পড়ে। এরপর আবার দ্রবণ ঢালা হয়। এভাবেই তৈরি হয় সরের দই। কোনো সন্দেহ নেই যে এ এক চমৎকার উদ্ভাবন। আর মাটির পাত্র আগেই আঁচে গরম করে নেওয়ার ফলে একটা স্কোকি ফ্লেভারও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে সরের আরেক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। একে বলে সরমালাই। পাবনার বিখ্যাত সরমালাইয়ের কথা হয়তো অনেকেরই জানা। জানা না থাকলে খোঁজ নিয়ে রসনা মাতানো যেতেই পারে।
সর প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় মনে হলো, আমার এক বন্ধু জানালেন, তাঁর নানা প্রতিদিন সকালের নাশতায় ঘিয়ে ভাজা ফুলকো লুচি খেতেন ঘি আর মুধতে ভাজা সর দিয়ে।
সর নিয়ে অনেক কথাই হলো। তা হলো রসনাবিলাসের অংশ হিসেবে। তবে কেবল খাওয়া নয় মাখাও হয় সর। রূপচর্চায় সরের ভূমিকা কম নয়। সর এক দারুণ ময়েশ্চারাইজার। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, এক্সফোলিয়েট করে, ব্রণ কমায়। আছে এমন আরও কত উপকারিতা।
সর দিয়ে ত্বক পরিচর্যায় আবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও উপস্থিত। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঠাকুরবাড়িতে ছোট–বড় সবারই পালোয়ানের কাছে কুস্তি লড়া ছিল বাধ্যতামূলক। ফলে ছোট রবিকেও কুস্তি লড়তে হতো। সেটা তাঁর মায়ের পছন্দ ছিল না। বাকিটা না হয় তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘সকালবেলায় রোজ এত করে মাটি ঘেঁটে আসা ভালো লাগত না মায়ের, তাঁর ভয় হতো ছেলের গায়ের রং মেটে হয়ে যায় পাছে। তার ফল হয়েছিল, ছুটির দিনে তিনি লেগে যেতেন শোধন করতে। শোধনক্রিয়ার সামগ্রী হিসেবে থাকত বাদাম-বাটা, সর, কমলালেবুর খোসা, আরও কতো কী...।’
খোদ রবীন্দ্রনাথ যখন ত্বকচর্চায় সর ব্যবহার করেছেন, তখন সুন্দরীরা করলে দোষের কী। কিন্তু বিষয়টি ঠিক ভালো লাগেনি কলকাতার ব্যান্ড দল ‘চন্দ্রবিন্দু’র। তাই তো তারা এককালে স্যাটায়ার করে বেঁধেছে ‘ত্বকের যত্ন নিন’ শিরোনামে একখানা গান। সেটাই না হয় শুনতে শুনতে শেষ করা যাক সর আখ্যান।
‘এমনিতে দুধ খেতে ভালো,/আরও ভালো সরটুকু খেতে।/লোভে পড়ে খাবেন না যেন/লাগান নাকের সামনেতে।… ত্বক যত চকচকে হবে/ চোখের চামড়া হবে পুরু।/পথে ঘাটে শুনতেও পাবেন কী জিনিস বানিয়েছ গুরু।’
তথ্যসূত্র: বাঙালির খাদ্যকোষ: মিলন দত্ত, উইকিপিডিয়া, দেশ পত্রিকা (১৮ জানুয়ারি ২০২০)
কৃতজ্ঞতা: রথীন ঘোষ, রাজবাড়ি; মিন্টু ঘোষ, সাতক্ষীরা; সনাতন ঘোষ, টাঙ্গাইল।