জিআই পণ্যের মর্যাদা পেল বগুড়ার দই
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাঙালি রসনায় দই জুড়িহীন। শেষ পাতে দই হলে তো কথাই নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে দই পরিবেশন করা হয়ে থাকে। দই থেকেও তৈরি হয় নানা পদ। রান্নায়ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার দই দিয়ে তৈরি হয় পানীয়। এটা কেবল আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর নানা দেশেই। দই পছন্দ করে না—এমন মানুষ খুব কমই আছে। আবার বাংলাদেশে দইয়ের কথা উঠলে চলে আসে বগুড়ার নাম।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শহীদ মিনার মাঠে প্রতিদিন সকালে বসে এমন দুধের বাজার। দূরদূরান্ত থেকে এখানে গরুর দুধ বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন গৃহস্থ–খামারিরা
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শহীদ মিনার মাঠে প্রতিদিন সকালে বসে এমন দুধের বাজার। দূরদূরান্ত থেকে এখানে গরুর দুধ বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন গৃহস্থ–খামারিরা
ছবি: সিদরাতুল সাফায়াত ড্যানিয়েল

সারা বাংলাদেশে দই পাওয়া গেলেও স্বাদে ও গুণে অতুলনীয় বগুড়ার দই। খোদ ইংল্যান্ডের রানি মুগ্ধ হয়েছেন বগুড়ার দই খেয়ে। এমনকি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এখানকার দইয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মন জয় করতে বগুড়ার দই পাঠানো হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

ভারতভাগের সময়ে থেকে এর স্বর্ণযুগ শুরু। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা থেকে শুরু হয় বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস। মূলত, শেরপুর উপজেলার দই-ই বগুড়ার বিখ্যাত দই হিসেবে পরিচিত।

দই তৈরির মূল জোগান এখান থেকেই আসে
দই তৈরির মূল জোগান এখান থেকেই আসে

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর গৌর গোপাল নামের এক ব্যক্তি পরিবারসহ ভারত থেকে এসে আশ্রয় নেন শেরপুরের ঘোষপাড়ার নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে। শুরুতেই তিনি টক দই সরবরাহ করতেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের কাছে। সেই দই নবাবদের অন্য রকম কদর ও প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তখন গৌর গোপালের এই দই খ্যাতি পেয়েছিল ‘নওয়াববাড়ির দই’ নামে। গৌর গোপালের ফর্মুলাতে তৈরি দইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে। পরে সময়ের বিবর্তনে স্বাদের বৈচিত্র্যের কারণে তা মিষ্টি দইয়ে রূপান্তরিত হয়।

এই বাজার থেকে দুধ কিনে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুধ ছেঁকে পরিষ্কার কড়াইয়ে ঢালা হয় জ্বাল দেওয়ার জন্য
এই বাজার থেকে দুধ কিনে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুধ ছেঁকে পরিষ্কার কড়াইয়ে ঢালা হয় জ্বাল দেওয়ার জন্য

পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বগুড়ার দই তৈরিতে হিন্দু ঘোষদের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন মুসলিম কারিগরেরাও। তখন গৌর গোপালের পাশাপাশি মহরম আলীর দই এবং বাঘোপাড়ার রফাতের দইয়ের সুনামও ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

বিজ্ঞাপন

প্রণালি

কড়াইয়ে মাঝেমধ্যে নেড়ে দিতে হয়, যাতে নিচে লেগে না যায় এবং দুধ ঠিকমতো জ্বাল পায়
কড়াইয়ে মাঝেমধ্যে নেড়ে দিতে হয়, যাতে নিচে লেগে না যায় এবং দুধ ঠিকমতো জ্বাল পায়

দুগ্ধজাত যেকোনো খাবারের মতোই ভালো দইয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উৎকৃষ্ট মানের দুধ। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জ থেকে দুধ সংগ্রহ করে কারখানায় আনা হয়। এরপরই শুরু হয় মূল প্রক্রিয়া। বগুড়ার বেশির ভাগ কারখানাতেই সনাতন পদ্ধতিতে দই তৈরি করা হয়। তাই গুণগত মান ঠিক রাখতে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতে হয় কারিগরদের।

প্রথমে পরিষ্কার বড় কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে নিতে হয়। তারপর সেটিকে দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। দই তৈরির মূল বিষয় হলো জ্বালের তারতম্য। এই জ্বালের ওপর ভিত্তি করে সাদা দই, শাহি দইসহ নানান ধরনের দই বানানো হয়। কারিগরেরা বলে থাকেন, দুধ যত জ্বাল হবে, দই তত ভালো হবে।

কড়াইয়ে মাঝেমধ্যে নেড়ে দিতে হয়, যাতে নিচে লেগে না যায় এবং দুধ ঠিকমতো জ্বাল পায়
কড়াইয়ে মাঝেমধ্যে নেড়ে দিতে হয়, যাতে নিচে লেগে না যায় এবং দুধ ঠিকমতো জ্বাল পায়

এভাবে দুধ জ্বাল দিতে দিতে যখন মোট পরিমাণের অর্ধেকে চলে আসবে, তখন তাতে পরিমাণমতো চিনি দিয়ে না গলা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। এবার দুধ উথলে উঠলে কড়াই নামিয়ে ফেলতে হবে।

এবার দই পাতার পালা। চুলার চারপাশে সুন্দর করে মাটির হাঁড়ি বা সরা বসানো হয়। একটু গরম হওয়ার পর তাতে দুধ ঢালা হয়। এবার তাতে পরিমাণমতো বীজদই যুক্ত করেন কারিগরেরা। দুধ ঢালা শেষ হলে বড় ঝাঁপি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে দই জমতে থাকে। জমাট বাঁধার পরে তা প্যাকেট করে শোরুমে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য।

মিষ্টি দই তৈরির জন্য দুধের সঙ্গে পরিমাণমতো চিনি মেশাতে হয়
মিষ্টি দই তৈরির জন্য দুধের সঙ্গে পরিমাণমতো চিনি মেশাতে হয়

শুরু থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মহিষের দুধ দিয়ে দই তৈরি করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে মহিষ কমে যাওয়ায় এখন গরুর দুধ দিয়েই তৈরি হয় দই। ১৬ মণ দুধে প্রায় ৪৫০ সরা দই বানানো সম্ভব বলে জানান কারিগরেরা।

রাজধানীতে সরবরাহ করা ছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশে রপ্তানি করা হয় শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী দই।

ছবি: লেখক

দই তৈরির মূল বিষয় হলো জ্বালের তারতম্য। দুধ যত জ্বাল হবে, দই তত ভালো হবে। মূলত, দই তৈরি করতে দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত দুধ জ্বাল দিতে হয়
দই তৈরির মূল বিষয় হলো জ্বালের তারতম্য। দুধ যত জ্বাল হবে, দই তত ভালো হবে। মূলত, দই তৈরি করতে দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত দুধ জ্বাল দিতে হয়
জ্বাল দেওয়া হয়ে এলে চুলার পাশে মাটির হাঁড়ি কিংবা সরা সাজানো হয়
জ্বাল দেওয়া হয়ে এলে চুলার পাশে মাটির হাঁড়ি কিংবা সরা সাজানো হয়
একটু গরম হওয়ার পর তাতে জ্বাল দেওয়া দুধ ঢেলে দেওয়া হয়
একটু গরম হওয়ার পর তাতে জ্বাল দেওয়া দুধ ঢেলে দেওয়া হয়
সব দুধ ঢালা হয়ে গেলে দেখতে অসাধারণ লাগে
সব দুধ ঢালা হয়ে গেলে দেখতে অসাধারণ লাগে
দুধ ঢালা শেষ হলে বড় ঝাঁপি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর আস্তে আস্তে দই জমতে থাকে
দুধ ঢালা শেষ হলে বড় ঝাঁপি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর আস্তে আস্তে দই জমতে থাকে
জমাট বাঁধার জন্য এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়। জমাট বাঁধার পরে তা প্যাকেট করে শোরুমে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য
জমাট বাঁধার জন্য এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়। জমাট বাঁধার পরে তা প্যাকেট করে শোরুমে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য
শোরুমে এলে সুসজ্জিত করে রাখা হয় নানান ধরনের দই
শোরুমে এলে সুসজ্জিত করে রাখা হয় নানান ধরনের দই
শোরুমে এলে সুসজ্জিত করে রাখা হয় নানান ধরনের দই
শোরুমে এলে সুসজ্জিত করে রাখা হয় নানান ধরনের দই
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৩, ১০: ০০
বিজ্ঞাপন