ঈদে মসলাবাজি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঈদের আনন্দ কড়া নাড়ছে ২০ রোজা পার হতে না হতেই। আর তার রেশ পড়ছে ঈদবাজারেও। একদিকে যেমন ঈদের জামা-জুতা নিয়ে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই, তেমনি হেঁশেলের অধিকারীরা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন ইয়া বড় বড় খাদ্য সামগ্রীর ফর্দ। এই বেলা বিনা বাক্যব্যয়ে সোনামুখ করে মুদিখানার দিকে রওনা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, নতুন জামা-জুতো পরে নামাজ, কোলাকুলি আর পাড়া বেড়ানো শেষে পেটে ছুঁচো ডাকলে তখন খাবারের টেবিলের দিকে পা বাড়াতেই হবে। আর ঈদের দিন বলে কথা। চোখ বুজে এই দিনটির কথা ভাবলেই নাকে ভেসে আসে সেমাই, ফিরনি, জর্দা, পোলাও, কোরমা, রেজালা, বিরিয়ানির সুঘ্রাণ। তবে মজার ব্যাপার হলো এই সুঘ্রাণ আর সুস্বাদের মূলে কিন্তু ওই একটি ব্যাপারই। সেটি হলো মসলাবাজি

প্রথমেই শুরু করি চাঁদরাত শেষে কাক ডাকা ভোরের গল্প দিয়ে। এক মাসের সংযম শেষে ঘুম ভেঙেই চায়ের পাতিল হাতড়ে ঘুম ঘুম চোখে চুলায় চা বসালে সেই ঘ্রাণে কেমন অনুভূতি জাগে তা চা–প্রেমীরাই জানেন। সেই সোনায় সোহাগা স্বরূপ দুটি এলাচ ছেড়ে দিয়ে ঘন দুধের ‘দুধ পাত্তি’ চা যেন অমৃতেরই আরেক রূপ। হালকা লিকারে মসলাদার রং চা–ও চলতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ঈদের সেমাইয়ের দুধে এলাচ-দারুচিনি ছাড়া কি চলে? এদেশের যেকোনো মিষ্টান্নে আস্ত গরম মসলার হালকা এক ফ্লেভার দেওয়া হয়। জর্দা, পায়েস, সেমাই, শাহি টুকরা—এলাচ দারুচিনির ঘ্রাণ তাতে আসতেই হবে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মসলা জাফরান তো রাজকীয় সব মিষ্টি খাবারের অলংকারস্বরূপ। কুলফি, মালাই জর্দা, ফিরনিতে জাফরান এক অনন্য বিলাসী অনুভূতি এনে দেয়।

এই ঠা ঠা রোদ্দুর আর বুকের ছাতিফাটা গরমের ঈদে খাবারের আয়োজনে শো স্টপার আসলে নানা ধরনের পানীয়ই। চলতে পারে জিরা পানি, লেবু-পুদিনার মোহিতো, আনারস বা কাঁচা আমের চিলার্স, তেঁতুল, তরমুজ বা বেলের শরবত। বোরহানি বা মলিদাও করা যায়। এই শরবত ও পানীয়গুলোতেও মসলা ব্যবহারের মুনশিয়ানা বদলে দিতে পারে দৃশ্যপট আর স্বাদও। টালা জিরার গুঁড়া, বিট লবণ, সরিষা ও গোলমরিচের সঠিক পরিমাণ ও প্রয়োগ ঘটালে তৃষ্ণানিবারক এই পানীয়গুলো একেবারে অন্য পর্যায়ে চলে যায়।

বিজ্ঞাপন

ঈদে আপনার প্রিয় খাবার কী? পোলাও-কোরমা, বিরিয়ানি বা কাবাব? নাকি চাট-চটপটি, পরোটার সঙ্গে খাসির রেজালা? প্রতিটি বাড়িতেই ঈদের কিছু ঐতিহ্যবাহী পদ থাকে যা বংশ পরম্পরায় তৈরি হয়ে থাকে। প্রপিতামহীর স্মৃতিমাখা কাটা মসলায় গরুর মাংস, শাশুড়ি মায়ের দুধ সাদা ডিমের কোরমা যা তিনি শিখেছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে, মায়ের হাতের অসম্ভব মজার চটপটি, ঈদ যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায় সেই বিশেষ পদটি না করলে। আর এই উৎসবধর্মী পদগুলো আসলে ঘুরেফিরে সেই মসলাবাজির গুণেই অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে। জিরা কাঁচা অবস্থায় ভিজিয়ে বেটে গরুর ঝাল-ঝোল, রেজালা, কালাভুনায় দেওয়া হচ্ছে। আবার সেই জিরাই শুকনা খোলায় টেলে গুঁড়া করে চাট-চটপটিতে ছড়িয়ে মূল ফ্লেভারটি আনছে। আবার আস্ত জিরার ফোড়নে পাঁচমিশালি নিরামিষ লুচির সাথে যেন অমৃতসম। ওদিকে দেখা যাচ্ছে তেলে ভেজে তুলে মোটা গুঁড়া করা জিরা ব্যবহার করা হচ্ছে চাটনির শান বাড়াতে।

আজকাল বহু ব্র্যান্ডের মসলা মিক্স সুলভে আর সহজে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ঈদের আগে মসলা–সংক্রান্ত প্রস্তুতির ব্যাপারটি কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ তবে এই মসলার মিশ্রণগুলো প্রায়শই সেগুলোর নামের প্রতি সুবিচার করতে পারে না, বিশেষ পদগুলোর সঠিক ফ্লেভার দেওয়া তো দূরের কথা। বিরিয়ানির তো আছে বহু রকমফের। কাচ্চি বিরিয়ানিতে যেমন ঝালের বালাই নেই, কিন্তু শাহি জিরা, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ, তেজপাতার সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয় চারদিক ডেক ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে। আবার হায়দরাবাদি বিরিয়ানির ফ্লেভারের মূলে কালো এলাচের সুঘ্রাণ ও শাহি জিরার মেটে ফ্লেভার। সরিষার তেলের তেহারি বা মোরগ পোলাওয়ে আবার ঠেসে মসলাপাতি ঢালবেন না যেন। যত গুড় তত মিঠা—এই তত্ত্ব দিয়ে কি মসলাবাজি হয়?

একটু খেয়াল করে বিভিন্ন বিশেষায়িত মসলাবিপণি, মুদিবাজার অথবা অনলাইন শপ থেকেও পছন্দমতো মসলা কিনে নিজের মতো করে মসলা তৈরি করে নিলে খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ বেড়ে যাবে বহুগুণ। সাধারণ হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া, এলাচ, দারুচিনি, তেজপাতা তো বটেই, কিছু বিশেষ মসলা ঈদের খাবারে আনে ব্যতিক্রমী, উৎসবমুখর আমেজ। কাবাবচিনি, তারা মসলা (স্টার অ্যানিস), শাহি জিরা, চার মগজ, বড় এলাচ, ছোট ধনিয়া বা রাঁধুনি—এই মসলাগুলোর ব্যবহারে একেকটি খাবারের পদ হয়ে ওঠে স্বাদকোরক উদ্বেল করা। আদা, রসুন, পেঁয়াজ বাটা কতটা মিহি হলো, বেরেস্তার রংটা ঠিক এলো কিনা অথবা লবঙ্গের গুঁড়া, রাঁধুনি বাটা ঠিক কখন দেওয়া হলো এসবই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই ছোট ছোট বিষয়ের মাধ্যমেই মসলাবাজ রন্ধনপটীয়সীরা যুগে যুগে ঈদের খাবারে ছড়িয়েছেন জাদু।

ছবি: শামীমা মজুমদার ও প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন