সত্যজিৎ রায় নামের সঙ্গেই যেন মিশে আছে কালোত্তীর্ণ বিষয়টি। আজ ২ মে এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্মদিন। প্রিয় মানুষরা তাঁকে ডাকতেন মানিক দা বলে।সেই পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে শিল্প মাধ্যমের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণের শুরু। আসলে মনে হয়, সময়ের আগেই সবকিছু ভেবে ফেলেছিলেন তিনি। বাঙালির শিল্প মাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। তাই তো আজও তিনি সবার জন্য সমান অনুপ্রেরণা ও অনুকরণীয়। সত্যজিতের গল্প, উপন্যাস,চলচ্চিত্র চিন্তার খোরাক যোগায় আর অন্তর্নিহিত অনেক কিছুকেই নিয়ে আসে সামনে। আজ মহারাজার ১০৪তম জন্মতিথিতে তাঁর অনবদ্য কিছু চরিত্রের লুক নিয়ে গল্প হোক।
ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
'ফেলুদা' চরিত্রের মাধ্যমে রহস্য, রোমাঞ্চ আর অনুসন্ধানের রস আমাদের দেশের পাঠক আর দর্শকদের সামনে এই প্রথম এভাবে উপস্থাপন করেন সত্যজিৎ রায়।বই আর চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্যটা স্পষ্ট। পাঠক বই পড়ে কল্পনার জগতে এক ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করে। পর্দায় যখন সেই চরিত্র দর্শক দেখে,তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। ফেলুদা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে সন্দেশ পত্রিকায় । ১৯৭৪ সালে 'সোনার কেল্লা' ও ১৯৭৮ সালে 'জয় বাবা ফেলুনাথ' নামে এই সিরিজের দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সত্যজিতের পরিচালনায় এই দুই চলচ্চিত্রে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গোয়েন্দা গল্প ও থ্রিলারের জগতে সারাবিশ্বে সেসময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে টিনটিন ও শার্লক হোমস। সেখান থেকে বের হয়ে ডিটেকটিভ গল্পে একেবারে বাঙালি ছোঁয়ায় ভিন্নধর্মী লুকের চরিত্র নির্মাণের দুর্দান্ত দক্ষতা দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ।
ফেলুদা চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, আহমেদ রুবেল, টোটা রায় চৌধুরী, আবীর চ্যাটার্জির মতো গুণী অভিনেতারা পরবর্তীতে এই চরিত্রে অভিনয় করলেও সত্যজিতের ফেলুদা ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।আসলে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্যাশন কখনো বিলুপ্ত হয়না, ফিরে ফিরে আসে সময়ের সঙ্গে। ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্রের ঢেউ খেলানো চুল,পায়ের উপর পা তুলে বসার রাজকীয় ভঙ্গি, ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি আর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব আর ক্ল্যাসিক পরিপাটি লুক আজও সব বয়সের তরুণদের জন্য প্রাসঙ্গিক। মিনিমালিজম সরসময় সব প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফেলুদার হাতে দেখা যায় সাদা ডায়ালের কালো বেল্টের ঘড়ি। এরকম নকশার ঘড়ির প্রতি সত্যজিতের বিশেষ দুর্বলতা ছিল কিনা জানা যায়না,তবে আগন্তক চলচ্চিত্রে অনীলা চরিত্রে মমতা শঙ্কর, জন অরণ্য সিনেমায় অপর্ণা সেনসহ বিভিন্ন সময়ে সত্যজিতের চরিত্রদের পর্দায় দেখা গেছে এমন ঘড়ি পরতে। ফেলুদার পরনে অনেকসময় থাকত খদ্দরের পাঞ্জাবি ও কাশ্মীরি শাল।
পাঁচ দশক আগের এই লুক আজও প্রিয় সকলের। রঙিন মাফলারের চল ছিল সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই। আজও তা সমান জনপ্রিয় ও সর্বজনীন ট্রেন্ড। এ সময়ের জেনজিদের মধ্যে রঙিন মাফলার বা স্কার্ফ পরার প্রবণতা দেখলেই তা বোঝা যায়। পোশাকের সঙ্গে প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের অভিব্যাক্তির সমন্বয় অনুসরণীয় হয়ে আছে এ প্রজন্মের সকল পরিচালক কিংবা লুক ডিজাইনারদের কাছে।
নায়ক সিনেমায় মহানায়ক উত্তম কুমার
ধনসম্পদ আর খ্যাতির মাঝেও নিঃসঙ্গতা মানুষকে জীবনের কোনো না কোনো সময় আঁকড়ে ধরে। খ্যাতির মোহে মানুষ অতীত ভুলে যায়। মহানায়কে উত্তম কুমারের অরিন্দম মুখার্জি চরিত্র যেন তারই এক প্রতিরূপ। সত্যজিৎ রায়ের মাস্টারপিস নায়ক চলচ্চিত্রে উত্তর কুমারকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আটপৌরে মিনিমালিস্ট লুক থেকে বেশ আলাদা আর নায়কোচিত লুকেই দেখা যায় উত্তম কুমারকে।
মহানায়কের দুর্দান্ত অভিনয়কে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্য পোশাক ও রূপসজ্জায় দক্ষতা অত্যাবশ্যকীয় ছিলো।মেকআপ আর্টিস্ট অনন্তা দাস এই সিনেমায় সুনিপুণভাবেই সেটা করেছেন। সেই সময়ে উত্তম কুমারকে দেখা যায় র্যালফ লরেনের কালো সানগ্লাস চোখে, হাতে মোভাডো ব্র্যান্ডের এনালগ ঘড়ি, জিপোর লাইটার হাতে।
এসব অনুষঙ্গ পরিচয় করিয়ে দেয় সত্যজিৎ ও উত্তম কুমার দুই মহারথীর রুচিকে। চুলের স্টাইল, স্যুট-প্যান্ট-টাইয়ের ফর্মাল পরিচ্ছদে আভিজাত্যের আবহ ছিলো উত্তম কুমারের লুকে।
অভিব্যক্তি দিয়ে যেমন অভিনয় করা যায়,পোশাক ও অনুষঙ্গে আভিজাত্যের ছোঁয়া চলচ্চিত্রকে দেয় আলাদা মাত্রা। সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' চলচ্চিত্র যেন তেমনই এক দৃষ্টান্ত।
নানা চরিত্রে উৎপল দত্ত
'আগন্তুক' সত্যজিৎ রায়ের শেষ চলচ্চিত্র। ৩৫ বছর ধরে নিরুদ্দেশ এক ভদ্রলোকের দেশে প্রত্যাবর্তনের গল্প। মনমোহন মিত্র চরিত্রে উৎপল দত্ত যেন সত্যজিৎ রায়ের জীবনের শেষ দিনগুলোর সামগ্রিক জীবনের ভাবনা বলে গেছেন। সময়ের চেয়েও আধুনিক চলচিত্র 'আগন্তুক'। সত্যজিৎও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের প্রতিভায়। বলেছিলেন, 'উৎপল যদি রাজি না হতো, তবে হয়তো আমি আগন্তুক বানাতামই না'।
আগন্তকে বহু বছর পর দেশে ফিরে আসা একজন মানুষ উৎপল। প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, রঙিন শার্টের ওপর পরেছেন ওভারকোট।বেশির ভাগ দৃশ্যেই হালকা বেগুনি, কমলা, বাদামি সুতির পাঞ্জাবিতে সুতার কাজ। কখনো বা এক রঙের পাঞ্জাবি পরতে দেখা যায় এখানে তাঁকে।
উৎপল দত্ত কেবল অভিনেতা ছিলেন না, অভিনয়ের অভিধান ছিলেন বলা যায় তাঁকে। তবে পোশাক নির্বাচন কালজয়ী করেছে তাঁর চরিত্রগুলোকে। হীরক রাজা চরিত্রে উৎপল দত্তকে দেখা যায় বিশেষ ধরনের আঙরাখা ঘরানার পোশাকে। ওপরে সাটিনের একরঙা কোটি, মাথায় বড় পাগড়ি, রত্নখচিত মুকুট,কানে দুল, গলায় কয়েক লহরের মুক্তার মালা, পাকানো মোচ, ঘন ভ্রু সব মিলিয়ে একজন নেতিবাচক মানসিকতার দাম্ভিক রাজাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণভাবে।
জন অরণ্যে মাঝবয়েসী লোকের চরিত্রে মোটা ফ্রেমের চশমায়, ধুতি পাঞ্জাবির ওপর কোটের মতো পোশাকে দেখা যায় তাঁকে। চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে বেছে নেওয়া হয়েছে বাস্তবসম্মত সাজপোশাক।
মগনলাল মেঘরাজ নামের ভয়ংকর নেতিবাচক চরিত্রে কেবল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর চোখে মোটা ফ্রেম মিশে গেছে চরিত্রের সঙ্গে। সত্যজিৎ যখন যে চরিত্রকে পর্দায় নিয়ে আসতেন, সেই চরিত্রটিকে আগেই ভেবে রাখতেন। সত্যজিতের কল্পনায় সৃষ্টি চরিত্রগুলোতে হুবহু মিশে গেছেন উৎপল দত্ত তাঁর বহুমুখী অভিনয়শৈলীর বদৌলতে।
গুপী-বাঘা চরিত্রে তপেন চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ
গুপী-গাইন বাঘা বাইনকে চেনেন না এমন বাঙালি কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। যুগে যুগে ক্ষমতাবানদের প্রভাব, নিপীড়িত মানুষের হাহাকার আর প্রতিবাদী মানুষের আগমনের গল্পসহ সবকিছুর অসাধারন সমন্বয় দেখা যায় এই চলচ্চিত্রে।
সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায়ের গুপী গাইন-বাঘা বাইনের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল এই চলচ্চিত্র। গুপী বাঘার সহজ সরল গ্রাম বাংলার দুই তরুন চরিত্রে কোঁচা দেয়া ধুতি,ফতুয়া, গামছা কেবল পোশাক নয় বাঙালির আত্মিকতাকে তুলে ধরে। ভুতের 'বর' তাদের পাবার পর পোশাকে চলে আসে রাজকীয়তা। কিন্তু তাদের সারল্য আর অভিব্যক্তি সর্বকালের সেরা দুই চরিত্রকে করে অনবদ্য।
মহানগর সিনেমায় আরতির চরিত্রে মাধবী মুখার্জি
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র মানে সমাজ পরিবর্তনের কোনো বার্তা। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে একজন নারীর সংসারের দায়িত্ব নেওয়া, চাকরীচ্যুত স্বামীর তা মেনে নিতে মানসিক সংঘাত ,একজন নারীর বিপণন-কর্মী হিসেবে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পণ্য বিক্রির মতো কনসেপ্ট খুবই সাহসী পদক্ষেপ। মহানগর চলচ্চিত্রের কথাই হচ্ছে। সমাজের সব কটাক্ষকে তুচ্ছ করে ইতিবাচক মুক্ত চিন্তার দারুণ প্রকাশ এই চলচ্চিত্র। মাধবী মুখার্জি অভিনয় করেছেন আরতি চরিত্রে। ছবির চিত্রায়ন থেকে পোস্টার সবকিছুতেই ছিল দর্শকদের মগজে চিন্তার খোরাক গুঁজে দেয়ার প্রয়াস। মহানগরের পোস্টারে দেখা যায় মাধবী দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে আছেন অন্য দিকে, তাঁর থুতনিটা ধরে ছিল অন্য একটি হাত, যে হাতের মালিক অদৃশ্য। অদৃশ্য ব্যক্তির অন্য হাতটি লিপস্টিক বোলাচ্ছিল মাধবীর ঠোঁটে৷
সেই সময়টায় তথাকথিত ভালো মেয়েরা গাঢ় রঙের লিপস্টিক দিত না। তাই এখানে দেখানো লাল লিপস্টিক শুধু সাজ ছিল না, বরং তা নারীর স্বাধীনতার প্রকাশ। মহানগর চলচ্চিত্র কেবল সামাজিক প্রেক্ষাপটের আধারে নির্মিত ছিলনা। ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষকে 'পাওয়ার ড্রেসিংয়ের' ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে।সেসময় মেয়েদের ঘর-কন্নার বাইরে কাজ করা ছিল খুবই বিরল। অ্যাংলো নারী বা যাঁদের ফিরিঙ্গি বলা হতো তাঁরা এধরনের কাজ করতেন। আরতি তাঁর ফিরিঙ্গি বন্ধু এডেনের কাছ থেকে শেখেন অনেক কিছু। আটপৌরে শাড়ির সাজে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা যাবে না। সে কারণে তাঁকে উপহার দেন এডেন সানগ্লাস ও লিপিস্টিক। র্যাভেনের ক্লাসিক ক্যাট আই সানগ্লাস আর ষাটের দশকে এসেই বাজার মাতানো এলিজাবেথ আর্ডেনের ভিক্টরি রেড লিপস্টিক এই চলচ্চিত্রে সত্যজিতের লুক ডিজাইনের অসাধারণ ক্ষমতাকে প্রকাশ করে।
নারীদের ঘরের বাইরে বের হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যে বলিষ্ঠ প্রতীকী উপস্থাপনার প্রয়োজন ছিল সেটা দারুণভাবে তুলে ধরে এই বিষয়গুলো। আরতিকে দেখা যায় কাজ শুরুর পর খুব সাবলীলভাবেই সেমি হিডেন বক্ষবন্ধনী ও সি থ্রু ব্লাউজ পরতে। খুব সূক্ষ্মভাবে সত্যজিৎ বুঝিয়েছেন এরকম ব্লাউজে একজন নারীকে অশ্লীল লাগেনা, এর মাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর ব্যক্তিত্ব ও পেশাদারিত্ব। মহানগরের মাধ্যমে পাওয়ার ড্রেসিংয়ের ধারনা আজও সমাজ চিন্তার পরিবর্তনের বাহক হয়ে আছে।
পথের পাঁচালীর সর্বজয়া চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
পথের পাঁচালী ট্রায়োলোজিতে যদি একটি চরিত্র নিয়ে কথা বলতে হয় তবে তা কঠিন। কিন্তু করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত সর্বজয়া চরিত্রটি যেন সবার চেয়ে আলাদা।সত্যজিৎ রায় নাকি প্রতিটি চরিত্র আগে থেকেই কল্পনা করতেন । ভেবে নিতেন কাকে দিয়ে কোন চরিত্রটি ফুটে উঠবে। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত এই দুই চলচ্চিত্রে সর্বজয়া রূপে অভিনয় করেছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহকর্মী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের গল্প সবার জানা। করুণা ও সর্বজয়া মিশে গিয়েছিল এক অভিন্ন সত্তায়।
দুর্গার ছোটবেলার চরিত্রটি করেছিলেন করুণার মেয়ে রুনকি বন্দ্যোপাধ্যায়।বাস্তবের সম্পর্কই পর্দায় প্রতিফলিত করেছিলেন পরিচালক। পৃথিবীর সকল ঘাত প্রতিঘাতকে পেছনে ফেলে আপন মানুষকে আগলে রাখার এক অসাধারণ ক্ষমতার দারুণ প্রদর্শন দেখা যায় সর্বজয়া চরিত্রে। দরিদ্র নারীর সারাদিনের ঘামে ভেজা আটপৌরে শাড়ী, কপালে বড় টিপ মন কেড়েছে দর্শকদের যুগে যুগে। কোনো মেকআপ ব্যবহার হয়নি কোনো দৃশ্যে।
সত্যজিতের প্রত্যেকটি কাজে সব সময় আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এক ঐকান্তিক প্রয়াস দেখা যায়। চরিত্রগুলোর লুক ডিজাইন আর সাজপোশাকে সে ছাপ স্পষ্ট। আর সেই সূত্র ধরেই মহারাজার মনের অন্দরমহলের ছাপ দেখা যায় এই চরিত্রগুলোর সাজপোশাকে।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম