উৎসব মানেই সাজপোশাকের তোড়জোড়। আর শারদীয় দুর্গাপূজার এক বড় অংশ জুড়েই আছে যুগে যুগে বাঙালি নারীর শাড়ি, গয়না, টিপ আলতা কাজল আর সিঁদুরের গল্প। বছর জুড়ে অপেক্ষা চলে এই আরাধ্য সময়ে নিজেকে সাজানোর। পূজার সাজপোশাক মানেই সাবেকিয়ানা। তবে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গয়না আর সাজে আধুনিক আমেজ আনলেই বা ক্ষতি কী! সময়ের আবর্তে সদাপরিবর্তনশীল ফ্যাশনের প্রভাব তো পড়বেই উৎসবের সাজে।
ফিউশন আর মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ চলতে পারে পোশাক নিয়ে। গয়না আর সাজে আসতেই পারে সাবেকিয়ানার শেকড়ে ডালপালা মেলা জেনজিয়ানা। এইতো সময়কে হার মানিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলা 'আমাদের পূজার সাজপোশাকের গল্প'। আর এই গল্পই উঠে এসেছে দেশের সৃজনশীল চার ফ্যাশন উদ্যোগ ভূমিসুতা, দি মালাকাইট ক্যাসকেট, কাদম্বরী ও চিত্রাঙ্গদার যৌথ আয়োজনে।
এখন মনে হতে পারে, আমাদের পূজার সাজপোশাকের গল্পে এই 'আমরা' আসলে কে। কাদম্বরীর কর্ণধার অন্যাকেই জিজ্ঞেস করা যাক এই বিষয়টি। অন্যার কথাগুলোর শোনার সঙ্গে সঙ্গে খুব মিলে গেল সব হিসেব। তিনি বললেন, 'এই আমরা মানে সত্যিকার অর্থেই আমরা সবাই। এই যে বাঙালি নারী আমরা। তা আমরা যে টাইমলাইন বা সময়কালেরই হই না কেন, আমাদের সাজপোশাক দেখলেই আমাদেরকে চেনা যায়'। আমরা সাজের বেলায় কিছুটা ম্যাক্সিমালিস্ট। গয়নার বাক্সের সব গয়না একসঙ্গে না পরলে 'কেমন খালি খালি লাগে' এমন একটা ভাবনা আমাদের মাঝে যুগ পাল্টালেও সমানভাবেই কাজ করে।
আবার সেই গয়নায় এখন ফিউশনের ছোঁয়া চাই আমরা। অত ভারী আর জবড়জং ডিজাইনের বদলে হালকা আর সহজে ক্যারি করা যায় এমন ম্যাটেরিয়াল আর নকশা খুঁজি গয়নায়। এটার সঙ্গে সেটা মিলিয়ে মনের মতো করে সাজাতে ভালোবাসি নিজেকে। আর সেই সব গল্পই খুঁজে পাওয়া গেল এই ৪ উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াসের সাজপোশাকের আখ্যানে।
ধাতব গয়নায় অ্যান্টিক শেড আর ঝকঝকে ফিনিশ দুটিরই দেখা মিলছে এখানে। নকশায় আধুনিক আমেজ আর সাবেকী প্যাটার্ন দুটিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কাদম্বরীর সৃজনে। আলাদা করে বলতে হয় শাড়িগুলোর কথা। একদিকে দেখা যাচ্ছে সেই ঐতিহ্যবাহী বালুচরী শাড়িকে নতুন করে এই প্রজন্মের কাছে নজরকাড়া উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়েছে। হয়তো এভাবে সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে একে বাঁচিয়ে না রাখলে হারিয়েই যাবে ট্রেন্ডের বাইরে চলে গিয়ে এমন সব ট্র্যাডিশনাল শাড়ি। সেদিক থেকে ধন্যবাদ প্রাপ্য শাড়ির উদ্যোগ ভূমিসুতার।
এর কর্ণধার প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে জানা গেল, তাদের মূলমন্ত্রই হচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্যে আধুনিকা নারীর বাঙালিয়ানা। তাদের শাড়িগুলো দেখলে কিন্তু এর সার্থকতা বোঝা যাচ্ছে ভালোভাবেই। বালুচরীর পাশাপাশি আরেক ক্ল্যাসিক সাবেকি আমেজের জরীপাড় শাড়ির অনুপ্রেরণায় তারা এনেছেন 'সুনেহরী' নামের নিজস্ব শাড়ির সিরিজ। মায়ের শাড়িরই আধুনিক রূপ বলা চলে একে।
আমাদের সাজপোশাকের গল্পে আরও আছে দি মালাকাইট কাসকেট-এর শাড়ি। এ উদ্যোগটি দুই বোন অনন্যা ও অন্তরার। তাঁরাও ঐতিহ্যের শক্তিতে আধুনিক আমেজের নকশা ফুটিয়ে তোলেন তাঁদের প্রতিটি শাড়িতে। এবারে আসা যাক ব্লাউজের কথায়। জুতসই আর সঠিক ফিটিং তো বটেই, নজরকাড়া ডিজাইনের ব্লাউজ না হলে পুরো শাড়ির লুকটিই মাটি হতে পারে। ব্লাউজ এখন আর অনুষঙ্গ নয়, বরং স্বতন্ত্র পোশাক, যা শাড়ির সমান গুরুত্ব বহন করে এমন লুকে।
এখানে সেই গুরুদায়িত্ব রয়েছে এক্সক্লুসিভ ব্লাউজের উদ্যোগ চিত্রাঙ্গদার ওপরে। আর বলাইবাহুল্য, সে কাজটি সার্থভাবেই করেছেন এর কর্ণধার খাদিজা। আসলে পোশাক, অনুষঙ্গ আর সাজ মিলিয়েই একেকটি লুক তৈরির গল্প বাস্তব রূপ পায়। আর এই আমাদের পূজার সাজপোশাকের গল্পের কুশীলবেরা সকলেই অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে নিজেদের জায়গা থেকে নিজেদের কাজটি করেছেন সফলভাবে।
পুরো আয়োজনের আইডিয়া, থিম আর এখানে যে বিশেষ গল্পটি চিত্রায়ন করা হয়েছে সে কাহিনী না শোনা পর্যন্ত আসলে কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়ে যাচ্ছিল। তাই সে নিয়ে হাল ফ্যাশনের তরফ থেকে জানতে চাওয়া হলো অন্যার কাছে। তিনি বললেন, আসলে এই আগস্ট মাসে এফ-কমার্স ও ই-কমার্সভিত্তিক ফ্যাশন উদ্যোগগুলো রীতিমতো অস্তিত্বসংকটে পড়ে গিয়েছিল। আর সেসময় শুধু নিজে নয় বরং সবাই মিলে একে অপরের হাত ধরে একসঙ্গে উঠে দাঁড়ানো আর ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প থেকেই এই কোল্যাবরেশন শ্যুটের কথা মাথায় আসে তাঁর। আর তাঁর উদ্যোগ কাদম্বরীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ভূমিসুতা, দি মালাকাইট ক্যাসকেট ও চিত্রাঙ্গদা একসঙ্গেই পরিকল্পনা করে কাজটি করেছে।
এই শ্যুটের ছবিগুলোকে কোনোভাবেই ফ্যাশন পণ্যের শ্যুট বলা যায়না। বরং এক ধরনের স্টোরি টেলিং বা ন্যারেটিভের ব্যাপার রয়েছে এখানে। আর সে প্রসঙ্গে যেতেই একবাক্যে সায় জানালেন অন্যা। সেইসঙ্গে জানা গেল এই দৃশ্যপটের মজার পটভূমিটি। কাজকর্ম সেরে পান সাজতে সাজতে বা আচার অনুষ্ঠানের আগে সাজগোজ করতে গিয়ে বাড়ির জা-দের গল্প আর মজার সময় কাটানোর মুহূর্তগুলোকেই ফ্রেমবন্দী করেছেন তাঁরা। সে গল্পে হয়তো থাকে সদ্য পেরোনো কৈশোরের স্মৃতির বয়ান। হয়তো খুনসুটিতে উঠে আসে শ্বশুরবাড়িতে কে কী বলল বা করল সে গল্পও। আসর জমলে কি আর গল্পের শেষ থাকে! সাজতে গিয়েও হয় অনেক মজার সব কাহিনী। ও তাকে টিপ পরিয়ে দিল তো সে ওর শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে দিল। হয়তো চুলও বেঁধে দেওয়া হয় একে অন্যের। এমন সব সুন্দর মুহূর্তগুলো আরও সুন্দর হয়ে ওঠে শাড়ি-গয়নার চোখ জুড়ানো সাজে।
সে সাজে যেমন আছে বাঙালিয়ানা আর সাবেকিয়ানা, তেমনই আছে আধুনিকতার স্পর্শ। অন্যা জানালেন, এখানে দুটি দৃশ্যপট সাজানো হয়েছে। একটি বেশ আগের সাবেকি স্টাইলে। আর আরেকটিতে আছে হালকা সাজে ছিমছাম শাড়ির লুক। তিনি বললেন, পূজার সাজপোশাকে আসলে ফিউশন করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আর আমাদের ঐতিহ্যের ছোট ছোট বিষয়গুলোকেও এই পূজার সাজপোশাকে সুন্দরভাবে তুলে আনা যায়। পরিশেষে বলতে হয় চমৎকার ফটোগ্রাফির কথা। আলোকচিত্রী সাদমান সাকিব শান্ত আলোর ব্যবহার আর আসর জমানো সাবেকি আমেজের সম্পাদনায় প্রতিটি শাড়ি-গয়নার ডিটেইলিং নিখুঁতভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। আর আমাদের পূজার সাজপোশাকের গল্পের মডেল হয়েছেন ফারাহ, অবন্তি ও কেয়া।
শাড়ি: ভূমিসুতা ও দি মালাকাইট ক্যাসকেট
ব্লাউজ: চিত্রাঙ্গদা
গয়না: কাদম্বরী
ফটোগ্রাফি: সাদমান সাকিব শান্ত
মডেল: ফারাহ, অবন্তি ও কেয়া