তিনি দ্রোহেও আছেন, প্রেমেও আছেন। উভয়ে একাকার এই মানুষটিকে বিদ্রোহী কবি বলেই জানি আমরা। সবসময় তাঁর দ্রোহের গান, কবিতা নিয়েই কথা হয় বেশি। অথচ তাঁর গানগুলো বলে অন্যকথা। সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে এক পরমপ্রেমিক পুরুষের প্রতিচ্ছবি। অবশ্য প্রেমে তো দ্রোহ থাকেই সর্বান্তকরণে। বলা হয়, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরকে পেতে দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করে না। যুদ্ধে যাওয়ার আগে বা যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে প্রিয়ার মুখটিই সবচেয়ে বেশি আরাধ্য মনে হয়। যুদ্ধের ময়দানে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, বুঝিবা সেই মুখটিই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। ওয়ালেটে রাখা তার ছবিটি প্রেরণা জাগায় ক্ষণে ক্ষণে। আবার দ্রোহের পরতে পরতেও কিন্তু মিশে থাকে প্রেম অবলীলায়। দেশের জন্য, বঞ্চিত মানুষের জন্য, কোনো এক ন্যায্য দাবির জন্যও। প্রেম আসলে প্যাশন। আবেগ যাকে বলি আমরা। আর সেই প্রেম শুধু আত্মিক বা অশরীরী নয়। প্রেম আকর্ষণ জাগায়। শিহরণ সৃষ্টি করে। দেয় অ্যাড্রিনালিন রাশ। প্রেয়সীর সৌন্দর্য উদ্বেল করে হৃদয়। হৃদস্পন্দন বাড়ায়। সেই ধুকপুক একাকার হয়ে যায় ভালোবাসার অভিব্যক্তিতে।
নজরুলের গানের প্রেমরসে এই অভিব্যক্তি টইটম্বুর; আকর্ষণের মূলমন্ত্রে ডুবে থাকে আকন্ঠ। আর এখানেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের সঙ্গে নজরুলগীতির পার্থক্য। প্রেমাষ্পদের রূপবন্দনায় রাখঢাক নেই নজরুলের। প্লেটোনিক লাভের ধারেকাছে যান না তিনি। বরং প্রিয়ার রূপে 'দিল' ফাঁসিয়ে নিজেকে আষ্টেপিষ্ঠে সমর্পণের আকুতি দেখি আমরা সেখানে। প্রেম যেন তাঁর গানে মধুর মতো মেখে থাকে। শীতের দিনে উষ্ণজলের মতো আবেশী অনুভূতি দেয়। প্রখর রোদে হঠাৎ বৃষ্টির মতো পুলক জাগায়। নজরুলের মধ্যে কিছুটা পাগলাটে, খেয়ালী আর শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যের কথা উঠে এসেছে তাঁর জীবনের নানা গল্পে। যুদ্ধে গিয়েছেন, এ অঞ্চল থেকে সে অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। রুটি বানানো থেকে শুরু করে গানের দলে নাম লিখিয়েছেন পেটে ভাত জোটাতে। জেল খেটেছেন, সে কথা তো সবাই জানি আমরা।
কবির জীবনে প্রেম এসেছে একাধিকবার। নজরুলের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও কবির সঙ্গে সংসার করা হয়নি তাঁর প্রথম স্ত্রী সৈয়দা খাতুনের। পৈতৃক নামটি শুনে খটকা লাগছে? নজরুলের দেওয়া নার্গিস নামেই বেশি পরিচিত তিনি। ফার্সি, আরবি শব্দের জাদুকর ছিলেন নজরুল। চর্চাও করেছেন প্রচুর। আর ফার্সি সাহিত্যে নার্গিস ফুলের আছে আলাদা অবস্থান। সাদা ড্যাফোডিল বলা যায় একে। তীব্র সৌরভ আর আর ধবধবে সাদা, পেলব পাপড়ির জন্য নার্গিস ফুলের এত কদর। নজরুল তাঁর প্রথম প্রেম আর প্রথম স্ত্রীর নাম দেন নার্গিস। নানা কারণে নজরুল-নার্গিস ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে বাস্তব সত্য। এক হতে পারেন নি তাঁরা। তবে নার্গিসের বাড়ি, কুমিল্লার দৌলতপুরে বসেই নাকি কবি ১২০টি গান আর ১৬০টি কবিতা লেখেন। এরপর নানা গুঞ্জন আর জনশ্রুতি শোনা যায় অনেক নারী আর কবিকে নিয়েই। এমন বাবরি দোলানো ঝাঁকড়া চুলের শিশুর মতো সরল হাসির সুঠাম পুরুষের আকর্ষণ কি আর এড়ানো যায়!
তিনি গান শেখাতেন বিখ্যাত গায়িকা কানন দেবীকে। তাঁকে নিয়েও প্রচলিত হয়েছিল নানা গল্প। নজরুল সংসার করেছেন দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলার সঙ্গে। এ নামটিও তাঁরই দেওয়া। তাঁর আসল নাম আশালতা সেনগুপ্ত। তবে একটি কথা না বলে পারা যায় না। নজরুলের প্রথম প্রেম, প্রেমে বিচ্ছেদ আর সেই যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয় থেকে যে গান আর কবিতা উৎসারিত হয়েছিল, সংসারী নজরুল আর তেমন করে বুঝিবা লিখতে পারেননি। প্রমীলার প্রতি নজরুলের প্রগাঢ় টান, সুখে-অসুখে তাঁর পাশে থাকা, সন্তানদের জন্য ভালোবাসা নিয়ে কোনো কথাই হতে পারে না। কিন্তু প্রেমের সেই পাগলাটে, খ্যাপাটে, শিশুসুলভ অথচ দুর্নিবার আকর্ষণীয় রূপটি সেই নার্গিসের প্রেম থেকেই তৈরি হয়েছিল বোধকরি। নজরুলের গানে আর কবিতায় নারীর সৌন্দর্য পেয়েছে নানা মাত্রা। তবে পরী বা দেবী নয়, তিনি মানবীরূপেই পেতে চেয়েছেন তাঁর প্রেমিকাদেরকে। আজ নজরুলের প্রয়াণ দিবসে তাঁর তিনটি অনবদ্য সুরময় সৃষ্টির পংক্তিমালাকে নতুন আলোয় দেখতে চেয়েছি আমরা।
প্রেমের গান যদি বলি, সবচেয়ে জনপ্রিয় নজরুলগীতি মনে হয় আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন। প্রেয়সীর কেশরাজি নজরুলকে বড় টানে। খোঁপার বাঁধন আলগা হতেই দিল ফেঁসে যাওয়ার মহাবিপদসংকেত পান তিনি। আবার এই গানে নজরুলের বিদেশি ভাষার মাধুর্য দিয়ে বাংলা গানকে সাজানোর মুনশিয়ানাও মুগ্ধ করে আমাদেরকে। দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি...আন্ধা ইশক মেরা কাস গায়ি! ভাষার এই ইকেবানায় আকুতি, আর অসহায়ত্বের সঙ্গে ইনফ্যাচুয়েশনের জারণে যেকোনো প্রেমিক পুরুষই নিজেকে মেলাতে পারবেন।
কল্পনার প্রেয়সী এখানে বেলিফুলের মালা জড়িয়েছেন হাতখোঁপায়। পরেছেন চোখজুড়ানো জামদানি শাড়ি। আপনমনে নিজের মতো করেই সেজেছেন কাজল, টিপ আর গোলাপি ঠোঁটে। নজরুল সবসময়ই ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। তাই তো এখানে কানে গলায় কিছুটা ট্র্যাডিশনাল গয়না থাকলেও প্রেয়সীর হাতে দেখা যাচ্ছে স্টেটমেন্ট আংটি ও ব্রেসলেট। তাঁর কেশের গন্ধে কখন 'লুকায় আসিল লোভী মন', তা তো গানের লাইনেই আছে। এই লোভে দোষ নেই। এ তো চেয়ে থাকার লোভ, রূপে ফেঁসে যাওয়ার লোভ আর ভালোবেসে দগ্ধ হওয়ার লোভ। আর সেই রূপ আর সৌন্দর্যকে মাত্রা দিতে আমরা আমাদের হেরিটেজকেই আশ্রয় করে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।
ভালোবাসায় মাঝেমাঝে দূর থেকে দেখাটাই যেন জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি চকিত চাহনি বা এক চিলতে হাসির দেখা মেলে তবে তো কথাই নেই। 'নাচে ইরানি মেয়ে'– এই গানে এমনই এক অনুভূতির ছাপ পাই আমরা। নজরুলের গানে ইরানি মেয়েদের রূপের প্রতি মুগ্ধতা আরো দেখা যায়। এখানে আবার ইরানি মেয়ের নাচের তালে নেশাগ্রস্ত হয়ে শিস দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে জিপসি ছেলের প্রেমপ্রকাশের আলামত মেলে। এভাবেই তো শুরুটা হয়! বিদেশিনী তায় আবার।
মুগ্ধতা আর কিছুটা সংকোচ থাকলেও তাঁর রেশমি ঘাগরি আর ভুরুর তলে ছোটা বিজলিতে ঘায়েল হতে বাধা কোথায়! আমাদের ইরানী মেয়ে এখানে চোখজুড়ানো বসরাই গোলাপের বেশে সামনে এসেছেন। এথনিক আমেজের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আর জমকালো গয়নায় সেজেছেন। লম্বা বেণী দুলিয়ে সবার হৃদয়হরণ করছেন অপরূপ সাজে। নজরুল বেশ এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন; এজন্যই বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্য দেশের নারীদের রূপেও মজেছেন। তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই গান।
কখনো আবার প্রেমে কাছে আসার আকুতিও আচ্ছন্ন করে দেয় দেহমন। তখন রাখঢাক শিকেয় তুলে নজরুলের মতো বলতে ইচ্ছে করে, 'মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল!' কানে তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল দোলানোর প্রতিশ্রুতিতেও যদি টলে তাঁর মন! ভালোবেসে চাঁদ-তারা এনে দেওয়ার কথা আসলে চলে আসে প্রেমিকের বয়ানে যুগে যুগে।
আমাদের প্রিয়াকে এখানে আমরা দেখতে চেয়েছি নজরুলের সময়ের আধুনিক নারীর রূপে, ভিনটেজ লুকে। চল্লিশ, পঞ্চাশের দশকের ঢেউ খেলানো ব্যাংসের হেয়ারস্টাইল আর সে সময়ের সুপারট্রেন্ডি সিকুইনের ঝিলিমিলি শাড়িকে গাউনের লুক দিলে নজরুল মনে হয় কিছু আপত্তি করতেন না। চুলে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মুক্তাগুলো খোঁপায় তারার ফুলেরই দ্যোতনা। বডি জুয়েলারি, চোকার আর ছোট্ট স্টাডেও থাকা মুক্তা আকর্ষণের সঙ্গে আভিজাত্যের মিশেলে প্রিয়ার সৌন্দর্যকে দিয়েছে অন্যতর মাত্রা।
নজরুলের প্রেমের গান তো অনেক। তার মধ্যে থেকে অত্যন্ত জনপ্রিয় আর অনবদ্য এই তিনটি গানকে আমরা চয়ন করেছি। এর মধ্যে দিয়ে দেখে নিতে চেয়েছি আমরা প্রেয়সীর আলগা হয়ে আসা খোঁপার বাঁধন, ইরানি মেয়ের নাচের সম্মোহন আর প্রিয়ার চুলের তারার ফুলে ভালোবাসার স্নিগ্ধ ও মাধুরীময় প্রকাশ। সেই অনুভূতি ধরে রাখতে চেয়েছি শব্দে, স্থিরচিত্রে আর ভিডিওতেও৷ প্রেমিক নজরুল অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন সকল প্রেমিকের অন্তরে, এ তো অস্বীকারের জো নেই। তবে আমাদের প্রয়াস পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দও আমাদের কম নয় অন্তত আজকে কবির প্রয়াণদিনে।
মডেল: সাদিয়া আয়মান
ছবি: হাদী উদ্দীন
স্টাইলিং: দিদারুল দীপু
ভাবনা: শেখ সাইফুর রহমান
পোশাক: জামদানি শাড়ি ঘর, সাফিয়া সাথী, চিত্রাঙ্গদা
গয়না: ক্যানভাস, গ্লুড টুগেদার, সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি
জুতি: লোকাল লেবেল
লোকেশন: স্টুডিও ক্যানভাস
মেকওভার : পারসোনা
আয়োজন: টিম হাল ফ্যাশন
সার্বিক তত্বাবধান: জাহিদুল হক
ভিডিওগ্রাফি: কানিজ ফাতেমা
সমন্বয়: নাদিয়া ইসলাম, ফ্লোরিডা শুভ্রা রোজারিও