স্বাভিমানী তরুণদের হাত ধরে লাল হয়েছে বাংলাদেশের বিজয় নিশান
শেয়ার করুন
ফলো করুন

লাল ও কালো দুটি স্বতন্ত্র ও বিপরীত ধারার রং। তবে অন্য কোনো রং মিলিয়ে দুটি রঙের একটিও বানানো সম্ভব নয়। কালো তো শোকের রং হিসেবেই চলে আসছে বরাবর। প্রয়োজনে লাল রং কিন্তু হয়ে উঠতে পারে শক্তি, প্রতিবাদ ও স্বতন্ত্রের প্রতীক। এ কথাটি প্রমাণ হয়েছে আবারও। তবে মাথায় লাল ফেটি বেঁধে প্রতিবাদের এই ধারা কীভাবে চালু হলো? চলুন তবে এক নতুন প্রতিবাদী ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে ঘুরে আসি পুরোনো প্রতিবাদের ইতিহাসের পাতা থেকেও।
 
‘মাথায় লাল ফেটি বেঁধে এগোচ্ছে ছেলেটি। তার চোখে জ্বলজ্বল করছে তেজ, প্রতিবাদ আর স্বপ্ন’—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এটি ছিল রোজকার ছবি। এই আন্দোলনে প্রথমে মাথায় জাতীয় পতাকার ফেটি বেঁধেই দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের একাত্মতার প্রকাশ করছিলেন প্রতিবাদীরা। কিন্তু এরপরই শুরু হয় রক্তের বন্যা। তাই দেশের পতাকা এখন পুরোটাই লাল হয়ে গেছে শহীদের রক্তে, এরই প্রকাশ ঘটাতে মাথায় লাল ফেটি বাঁধা শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। যুদ্ধের রং লাল তার আপন মহিমায় হয়ে ওঠে প্রতিবাদের রংও।

তবে মাথায় লাল ফেটি বেঁধে প্রতিবাদ জানানোর ভাষাটি কিন্তু আজকের নয়। বেশ পুরোনো। অতীতে আন্দোলনকারীরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল নামতেন রাস্তায়। সেই মিছিলের সামনে অবশ্য কালো কাপড় লাঠিতে বেঁধে প্রতিনিধিত্ব দিতেন একজন। শোক ও শক্তির কী অপূর্ব মিশ্রণ ঘটত প্রতিবাদের ভাষায়! এবার আমরাও দেখেছি, কেবল মাথায় নয়, মুখেও লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করতে।
 
পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তির শেষযাত্রায় শোক প্রকাশে সবাই কালো রং ধারণ করেন। রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর স্বামী আলবার্টের মৃত্যুর পর থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি স্বামীর প্রতি শোক প্রকাশে কালো রঙের পোশাক পরতেন। তাঁর এসব পোশাক অবশ্য পরবর্তী সময়ে ফ্যাশন স্টেটমেন্টেরও জন্ম দেয়।  
 
রোমান পুরাণে লালকে রক্ত ও সাহসের প্রতীক হিসেবে রাখা হতো সামনের কাতারে। যুদ্ধ চলাকালে রোমান যোদ্ধারা লাল টিউনিকে নিজেকে সাজাতেন। বর্মের ওপরেও শোভা পেত এই রংটি। গ্ল্যাডিয়েটররাও যুদ্ধে যাওয়ার আগে নিজেদের সাজাতেন লালে। তবে কালো ছিল তাদের শোকের রং। প্রাচীন রোমের অধিবাসীরা শোকের দিনগুলোতে অন্ধকার ও কালো পোশাককে প্রাধান্য দিত। রাজপুত ও মারাঠা যোদ্ধারা যুদ্ধের আগে মাথায় লাগাতেন লাল তিলক। সুতরাং যুদ্ধের সঙ্গে লালের এই সংযোগটি ঠিক নতুন নয়। রোমান জেনারেলরা যুদ্ধ জয়ের পর আনন্দ উৎসব করতে তাঁদের সমস্ত শরীর রাঙাতেন লাল রঙে।

বিজ্ঞাপন

ফ্যাশনেও লাল ও কালো রং বজায় রেখেছে নিজের আধিপত্য। লাল যে শুধু যুদ্ধ, রক্তপাত আর প্রতিবাদের প্রতীক, তা কিন্তু একেবারেই নয়। লাল উর্বরতার প্রতীকও বটে। প্রাচীন চীনে লালকে ধরা হতো সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। রোমান বধূরা বিয়েতে ‘ফ্ল্যাম্মেয়াম’ নামে একটি লাল চাদর জড়াতেন গায়ে। এমনকি এখনো তো বাঙালি কনেরা বিয়েতে পরেন লাল বেনারসি। গ্রিস, আলবেনিয়া ও আর্মেনিয়ান কনেরা বিয়েতে পরেন লাল ওড়না।
 
আবার ক্ল্যাসিক বোল্ড রেড লিপস তো ফ্যাশনে কখনো পুরোনো হয় না। প্রাচীনকালে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় প্রথম লাল রঙের পাথরকে গুঁড়া করে হালকা লাল রঙের একটি টিন্ট বানানো হতো, সেই প্রথম লিপস্টিকের জন্ম। কেউ কেউ আবার বলেন, প্রাচীন মিসরে নাকি একধরনের বিশেষ পোকাকে মেলানো হতো মোমের সঙ্গে। রানি ক্লিওপেট্রার লিপস্টিক হিসেবে ব্যবহৃত হতো সেটি। ডেট নাইট থেকে শুরু করে যেকোনো বিউটি প্যাজেন্ট, পোশাকে লাল রং স্টেটমেন্টের জন্ম দিতে বাধ্য। তবে রাতের জমকালো উৎসবে কালো রঙের পোশাকের আছে আলাদা আবেদন। তবে যেকোনো অভিজাত অনুষ্ঠানে বা ফ্যাশন শোতে আছে রেড কার্পেটে হাঁটার

মধ্যযুগে লাল হয়ে ওঠে প্রতিপত্তির রং। রোমান সম্রাট শার্লেমেইন নাকি তাঁর প্রাসাদ রাঙিয়েছিলেন লাল রঙে, পরতেন লাল জুতা, এমনকি তাঁর চুলের রংও ছিল লাল।

এত ধরনের অভিব্যক্তির মিশেলে তাই লাল ও  মনোবিজ্ঞানীদের কাছেও ভীষণ শক্তিশালী রং। প্রেম, বিদ্রোহ, রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, উর্বরতা, নতুন সূচনা কিংবা প্রতিবাদ সবেতেই লাল রং যেন স্বতন্ত্র। তেমনি বাইরের সব রং থেকে দূরে সরিয়ে কালো রং প্রিয়জনের মৃত্যুতে মানুষকে দেয় সান্ত্বনা।

আর এরই মাঝে কালো আমাদের এবার শোকবিহ্বল করেছে। তবে সেই শোক শক্তি হয়ে ওঠার প্রেরণা হয়েছে লাল। আর স্বাভিমানী তরুণদের হাত ধরে লাল হয়েছে বিজয় নিশান।

ছবি: খাদিজা ফাল্গুনি ও প্রথম আলো

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১৩: ১৩
বিজ্ঞাপন