এটা প্রায়ই হয়। খুব পছন্দের কোনো ব্র্যান্ডের মনমতো পোশাক কিনতে গেলে সাইজ মেলে না। দেখা যায়, তা কেবল একটি ছোট পরিসরের বা রেঞ্জের দেহাবয়বের মাপেই পাওয়া যায়। পেটিট বা ছোটখাটো হালকা গড়নের এবং প্লাস সাইজ বা ভারী গড়নের মানুষের কথা কি তবে ভাবে না ফ্যাশনজগতের নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো? দুঃখজনক হলেও এই প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচকই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অথচ পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি যথেষ্ট বড় অংশেরই এ দলে পড়ার কথা।

টেলিভিশনের নাটক বা ছায়াছবিগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রের সফল সুখী মানুষটি যুগ যুগ ধরে শুধুই অত্যন্ত সুন্দর, নিখুঁত দৈহিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত, মাপমতো ফিগারের অধিকারী। রম্য চরিত্র বা পার্শ্বচরিত্রে হয়তো কোনো অপেক্ষাকৃত ভারী বা অতি ক্ষীণ শরীরের কারোর পর্দা উপস্থিতি দেখানো হয় লোক হাসানোর জন্য। এই ব্যাপারগুলো বিশ্বের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক জীবনে ঠিক কতটা ক্ষতিসাধন করছে, তা ভাবতে গেলে আতঙ্কিত হওয়ার কথা। শোবিজ জায়ান্ট আর ফ্যাশন দুনিয়ার নেতৃত্বদানকারী বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো প্রকৃতপক্ষে এর দায় এড়াতে পারে না। তবে বছর পাঁচেক ধরে ফ্যাশনজগতে এ ব্যাপারে বেশ বড় পরিবর্তন আসছে।
সর্বজনীন ও ইনক্লুসিভ ফ্যাশন

ফ্যাশন মানে নিছক সাজপোশাক নয়। ফ্যাশনে দুটি বিষয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এর একটি হচ্ছে ফ্যাশনের ক্ষেত্রে সব ধরনের দৈহিক বৈশিষ্ট্য, গাত্রবর্ণের প্রতি সমান স্বীকৃতি ও গুরুত্ব জ্ঞাপন। এ ক্ষেত্রে সব বর্ণ, দেহ ও চেহারার গড়ন বিশিষ্ট মানুষের প্রতিনিধিত্ব খুব প্রয়োজন। হঠাৎ হঠাৎ ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো যে তাদের কভার পেজে তথাকথিত বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে কোনো উজ্জ্বল মুখকে তুলে ধরে তার নিজস্ব দৈহিক সৌন্দর্যসহকারে, এটুকু মোটেই যথেষ্ট নয়। তবে ভোগ ম্যাগাজিনের কভারে প্লাস সাইজ তারকা লিজোর অনন্য সৌন্দর্য যেভাবে উঠে এসেছে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের লাখো বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের অধিকারী নারীকে উজ্জীবিত করবে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন বা ইভেন্টগুলোতে ছাড়া ছাড়া ভাবে নয়, বরং সংবেদনশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে সব ধরনের শারীরিক গড়ন ও গাত্রবর্ণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নয়তো ইনক্লুসিভ ফ্যাশনের ধারণা অধরাই রয়ে যাবে।
ফ্যাশন হাউসে বডি পজিটিভিটি

২০১২ সালের দিকে যখন দিকে দিকে হাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সর্বজনীন চরিত্রের অভাবের দিকে ভ্রুকুটি হানছিল বিশ্ববাসী, তখন টরিড নামে মার্কিন ইনক্লুসিভ ব্র্যান্ড সব ধরনের ও আকৃতির দেহের উপযোগী পোশাক নিয়ে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়ে বডি পজিটিভিটি আন্দোলনে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে ভেরো মোডা, পিঙ্ক ক্লোভ বা সাড়া জাগানো ইউনিভার্সাল স্ট্যান্ডার্ডের মতো বিশেষায়িত প্লাস সাইজ ব্র্যান্ড দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। আবার হাই স্ট্রিট ফ্যাশনে ইনক্লুসিভ বা সর্বজনীন বৈচিত্র্যময়তার অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছে আসোস, রিভার আউল্যান্ড, এইচঅ্যান্ডএম আর মনসুনের মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো। নাইকির মতো স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানিগুলো তাদের সাইজ রেঞ্জ বা পরিধি সম্প্রসারণে মনোযোগ দিচ্ছে, এ–ও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
দেহবৈচিত্র্যের নিরিখে ফ্যাশন মডেলিং

একটা সময় ছিল, যখন র্যাম্পই হোক বা টিভি বিজ্ঞাপন কিংবা ম্যাগাজিনের কভার—সব জায়গাতেই দাপট ছিল শুধুই ফ্যাকাশে, নির্লিপ্ত চেহারার হাড়গোড় বের হওয়া মডেলদের। সৌন্দর্য, আবেদনময়তা আর গ্ল্যামারের এই বাস্তবতাবিবর্জিত ও ক্ষতিকর রূপটির কবলে পড়ে মডেল হতে চাওয়া এবং মডেলদের অনুসরণ করা বহু কিশোরী-তরুণী অপূরণীয় সব শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিল বহু বছর ধরে। অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া, অপুষ্টি, ডিপ্রেশন থেকে এই কচি প্রাণগুলোকে বাঁচাতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দেয় অবাস্তব পর্যায়ের ক্ষীণকায় মডেলদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে। দিন এখন অনেকটাই বদলেছে। অধরা, ক্ষীণকায় কেট মসদের জায়গা নিয়ে নিয়েছেন কেট উপটনের মতো প্রাণবন্ত মডেলরা, যাঁদের দেহবল্লরী আর হাসিতে লাখো নারী নিজেকে খুঁজে পান। বিখ্যাত অন্তর্বাস ও রাতপোশাক ডিজাইনার ব্র্যান্ড ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের প্লাস সাইজ মডেলদের প্রতি অনীহা, ইনক্লুসিভ ফ্যাশনের প্রতি অতিরক্ষণশীল মনোভাবের জবাব দিতে অ্যাশলি গ্রাহাম ২০১৭ সালে একই ধরনের পোশাকে নিজের লাস্যময়ী, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ছবি দিয়ে ইনস্টাগ্রামে প্রতিবাদ জানান। আর তাতে সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অ্যাশলি গ্রাহামের ২০১৬ সালের স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের কভারে সাঁতারপোশাকে ছবির মাঝে যে বডি পজিটিভ বিপ্লবের ডাক ছিল, তাতে একসময় এগিয়ে এসেছে সবাই। এখন বিশ্বের সবার চেয়ে নামীদামি সুপারমডেলদের তালিকায় আছেন স্বাভাবিক নারীসুলভ দৈহিক সৌন্দর্যের প্রতীক পালোমা এলসেসার। বার্বি ফেরেইরার মতো সর্বজনপ্রশংসিত অভিনেত্রীরা। ‘ব্রিজিত জোনস ডায়েরি’, ‘নাটি প্রফেসর’ বা ‘শ্যালো হ্যাল’–এর মতো স্থূলতা-অবমাননা বা বডি শেইমিংকেন্দ্রিক ছবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে সবার হৃদয় জয় করছেন।
বডি পজিটিভিটি মানে যা–তা খেয়ে শুয়ে বসে দিনাতিপাত করা নয়। আবার তথাকথিত সঠিক ফিগারের ব্যক্তিবর্গ সবাই যে এমনভাবে দিন কাটান, তা–ও নয়। সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক দৈহিক গড়ন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল বৈচিত্র্যময় গাত্রবর্ণ ও চেহারার ধরন—সবকিছুকে আপন করে, সম্মান দিয়ে উদ্যাপন করতে হবে ফ্যাশনজগৎকে। ইনক্লুসিভ ফ্যাশনের মূল কথা মানতে গেলে বডি পজিটিভ হতেই হবে। নয়তো ফ্যাশনজগৎ সাধারণ মানুষের মনোজগতে কখনোই স্থান পাবে না, হয়ে যাবে জনবিচ্ছিন্ন।