মিতার গল্প: যেখানে দারুণ বন্ধুতা আইন ও ফ্যাশনের
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মানুষের ইচ্ছে ডানার বিস্তৃতি বহুদূর। কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতা অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। মাসুমা আক্তার মিথিলার ক্ষেত্রেও সেটি সত্যি। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন আইনজীবী হওয়ার। বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চাইতেন—মানুষের অধিকার আর সঠিক বিচার নিশ্চিতের কাজ করবেন।

নিজের নকশা করা ব্লাউজ হাতে মিথিলা
নিজের নকশা করা ব্লাউজ হাতে মিথিলা

সময় পরিক্রমায় হয়েছেন দক্ষ আইনজীবী; কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মিথিলা কেবল জটিল আইনের মারপ্যাঁচ নয়, ফ্যাশন আর দেশীয় শিল্পের প্রতিও ছিল সমান আগ্রহ। সে কারণেই, আইন পেশার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন’ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাশন ডিজাইনে পড়েছেন। তাঁর শিক্ষক বলেছিলেন তুমি খামোখাই শিখছ; প্র্যাকটিস করার সময়ই পাবে না এত ব্যস্ততায়।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু মিথিলার প্রতিজ্ঞা ছিল, আইন পেশার সমান্তরালে ফ্যাশনে সৃজনকর্ম চালিয়ে যাবেন। ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশনসচেতন ছিলেন তিনি। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় তাঁর বাড়ি। মিথিলা বললেন, ওই সময়ে মানিকগঞ্জ শহরে মিনি স্কার্ট, বুট এগুলো আমি পরতাম। আধুনিক ফ্যাশন ট্রেন্ড আমাকে টানত সব সময়।

আইনের প্রতীককে নকশায় রূপান্তরিত করেছেন মিথিলা
আইনের প্রতীককে নকশায় রূপান্তরিত করেছেন মিথিলা

২০১৫ সালে ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা শুরু করেন মিথিলা। মেয়ের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নিজের ডিজাইনের ব্লাউজ বানান অন্য অভিভাবকদের উৎসাহে। জানান, নিজের ডিজাইনে প্রায় ৫০০ ব্লাউজ তৈরি করেছেন। মেয়ের স্কুলের মেলায় স্টল দিয়ে ৩০টি ডিজাইনের ব্লাউজ করেন, যার সব বিক্রি হয়ে যায় এবং তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়। একসময় কেবল নিজের জন্যই ব্লাউজ বানাতেন ও পোশাক তৈরি করতেন; কিন্তু এরপর নিজের উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান, পূজার কেনাকাটা করতেন বিশ্বরঙ থেকে, মামলার কাজে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন; সেই সুবাদেই বিশ্বরঙে যাওয়া হয় পূজার কেনাকাটা করতে। সেখান গিয়ে দেখা হয়ে যায়, বিশ্বরঙের কর্ণধার বিপ্লব সাহার সঙ্গে। আমার ব্লাউজের ডিজাইন দেখে বললেন, আপনি চাইলে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। তাঁর উৎসাহেই কাজের শুরু। মিথিলা বলছিলেন, বৈশাখে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্লাউজ তৈরি করেছিলাম বিশ্বরঙের জন্য।

ফ্যাশনন শোতে মিথিলার সৃষ্টি
ফ্যাশনন শোতে মিথিলার সৃষ্টি

আইন পেশার সঙ্গে ফ্যাশন নিয়ে তাল মিলিয়ে কাজ করা খুব কঠিন ছিল, তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। তাঁর প্যাশনের জায়গা থেকেই কাজ করেছেন। ২০২২ সালে জানতে পারলেন, তিনি থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত। যদিও এতে মৃত্যুহার খুবই কম, নিরাময়যোগ্য। তবুও সারা জীবন চিকিৎসা আর পথ্যে থাকতে হয়। এই চিকিৎসা নিয়েই শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত। বন্ধুদের থেকে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখনো এর মধ্যে আছি। প্রতিনিয়ত যুদ্ধের মধ্যে থেকেও আইনপেশা, ফ্যাশন নিয়ে কাজ আর মানুষের ভালোবাসা আমাকে উজ্জীবিত করে প্রতি মুহূর্তে।

আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু অজয় রায়। তিনি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক। তাঁর ছোট মেয়ে তানিয়া রায় আমার খুব ভালো বন্ধু; ফ্যাশন অ্যাক্টিভিস্ট। সে বলল, চলো নিজেদের একটা উদ্যোগ করে ফেলি; সেখান থেকেই ‘মিতার গল্প’ শুরু। মিথিলার ‘মি’ আর তানিয়ার ‘তা’ মিলে ‘মিতা’ আর তারই গল্প, মিতার গল্প।
কলকাতায় চিকিৎসা নিয়ে আসর পর ‘ল থিমে’ কাজ করার কথা ভাবি। আমি যতদূর জানি, দক্ষিণ এশিয়ায় আইন থিমে কেউ এখনো সেভাবে কাজ করেননি। সম্ভবত আমিই প্রথম। এর পাশাপাশি আমি যোগব্যায়ামের থিমে কাজ করা শুরু করি।

প্রদর্শনীতে মিতার গল্প
প্রদর্শনীতে মিতার গল্প

আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা মেয়েরা পরিবারকে সময় দিতে গিয়ে, নিজেদের জন্য সময় দেয় না। মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য নিজের একান্ত সময় একান্ত প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যোগাসন খুব ভালো কাজ করে। কেবল শাড়ি নয়, ল থিমে পাঞ্জাবি, টি–শার্ট, শার্ট, যুগল পোশাক করেছেন মিথিলা। এ ছাড়া ইয়োগা থিমে করেছেন শাড়ি ও কুর্তি। তিনি খাদি নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি বুননে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে থাকেন। বিশেষ করে নানা কাউন্টের সুতি ও সিল্ক সুতা দিয়ে আকর্ষণীয় টেক্সচারের কাপড় তিনি বুনিয়ে নেন।

বনানীতে মিতার গল্পের আউটলেট ছিল। দুই মাস হলো বন্ধ করে দিয়ে এখন অনলাইনেই মিতার গল্পের উপস্থিতি অব্যাহত রেখেছেন মিথিলা।

আইনের নানা মোটিফ যখন মিথিলার নকশা সৃজনের উপজীব্য
আইনের নানা মোটিফ যখন মিথিলার নকশা সৃজনের উপজীব্য

মিথিলা চেষ্টা করছেন বিপ্লব সাহার নেতৃত্বে নতুন প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্ম উদ্যোক্তা ‘ভূমি’কে ভালোভাবে গড়ে তোলার। উদ্যোক্তা ভূমির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার।
কথোপকথনের ফাঁকে মিতার গল্পের পোশাকও দেখা হয়। আইনের মোটিফে দারুণ কিছু কাজ করেছেন তিনি। আইনপেশায় যেসব প্রতীক ব্যবহৃত ও প্রচলিত, যেমন বিচারকের হাতুড়ি, নথি, দাঁড়িপাল্লা, জাস্টিশিয়ার চোখে কালো কাপড় বাঁধা ইত্যাদিকে তাঁর পোশাকের জমিন অলংকরণে নকশার উপজীব্য করেছেন।  

সাদা ও কালো বা অপেক্ষাকৃত হালকা রংকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ করেন মিথিলা। টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন। এতে অবশ্যই রাষ্ট্রের, পোশাকশিল্প ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি–সংশ্লিষ্টদের পৃষ্ঠপোষণা প্রয়োজন; প্রয়োজন ওদের পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন আইকনসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াস, অভিমত মিথিলার।
তবে পণ্য উন্নয়নে প্রতিটি ধাপই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই মানসম্মত পণ্য তৈরি সম্ভব, বলেন মিথিলা। সঙ্গে আরও জানান, আমি প্রথম শাড়ির থিম অত্যন্ত সময়োপযোগী; সেটি ছিল একটি রায়—‘মেইন্টেইনেন্স অব আ ওয়াইফ আন্ডার মুসলিম ল ইন বাংলাদেশ, ডিএলআর–৪৮’। এই রায়কে আমি স্ক্রিন প্রিন্ট করেছিলাম আঁচলে।

শাড়িতে মামলার রায়
শাড়িতে মামলার রায়

আরেকটি যুগান্তকারী রায় ছিল, মায়েদের নাম দিয়েই সন্তানেরা পরিচিত হতে পারবে। যেকোনো জায়গায় ভর্তি হতে ও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে; বাবার নামের প্রয়োজন হবে না। এক লাইনে ‘মাদারস নেম এনাফ অ্যাজ গার্ডিয়ান ইন অফিশিয়াল ডকুমেন্টস’। এই রায়ের বিচারক ছিলেন নাইমা হায়দার। ২০২৩ ও ২০২৪ সাল বার অ্যাসোসিয়েশন অডিটোরিয়ামে আমি প্রদশর্নীর আয়োজন করেছিলাম। এসব পোশাক পরেই ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করেন আমার আইনজীবী সহকর্মীরা। তাঁর এই উদ্যোগ দারুণ প্রসংশিত হয়।

এভাবেই কাজ করছেন মিথিলা। পাশাপাশি তিনি নিজের পেশাকে আরও একটি খাতে কাজে লাগাচ্ছেন। তিনি উদ্যোক্তাদের জন্য আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। যাতে উদ্যোক্তাদের কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে না হয়।
সর্বোপরি সবার সঙ্গে মিলে কাজ করার বাসনা মিথিলার। দেশীয় উদ্যোগের উৎকর্ষ তিনি প্রত্যাশা করেন। আমাদের সৃজনশীলতা দেশের বাইরেও যেন প্রশংসিত হয়, আদৃত হয়, সেই স্বপ্নও দেখেন মাসুমা আক্তার মিথিলা।
ছবি: মিতার গল্প

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন