ফ্যাশন কেবল দেখার সৌন্দর্য নয়, বরং একধরনের বোধের প্রকাশ হয়েও উঠতে পারে। অনেক সময় ফ্যাশন আবার হয়ে দাঁড়ায় সময়ের দলিল। বিপাশা হায়াতের শিল্পচর্চা এবং ফাইজা আহমেদের ‘মানাস’ ব্র্যান্ডের শাড়ির জমিন ও আঁচলের ক্যানভাস মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে ফ্যাশনের এক অনন্য ভাষা। এখানে নান্দনিকতা সোচ্চার হয়েছে নৈতিকতার পক্ষে।
বিপাশা হায়াত ও ফায়জা আহমেদের এই কোলাবরেশন এক অনন্য যুগল সৃজন। এতে একদিকে আছে গভীর আত্মবিশ্লেষণ, অন্যদিকে ফ্যাশন। দুটি আলাদা দর্শনের মিথস্ক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে কাস্ট মাই ভোট ফর সক্রেটিসেস অ্যাকুইটালের অনুপ্রেরণায় তৈরি শাড়ি সংগ্রহ।
মানাসের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার ফায়জা আহমেদ জানান, তাঁর লক্ষ্য কোনো নির্ধারিত ক্রেতার সন্তুষ্টি নয়। সবার জন্য শাড়িগুলোর নকশা করেননি তিনি। তবে যাঁরা এই যুগলবন্দীর পেছনের গল্প বুঝবেন, তাঁদের প্রশংসাতেই তাঁর কাজের সার্থকতা লুকিয়ে আছে। এর আগেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আর কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম নিয়েও তিনি পোশাকের জমিন অলংকরণ করেছেন। পোশাকে তুলে এনেছেন বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, এমনকি রবি ঠাকুরের চিঠিও। এ ধরনের নকশার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, তাতে ফায়জা আহমেদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
কোভিড-১৯ অতিমারিতে, পৃথিবী যখন থমকে গিয়েছিল, মৃত্যুর ছায়া বিরাজ করছিল চারদিকে, বিপাশা হায়াত তখন ব্রুকলিনের এক অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন, একা। সেই নীরব একাকিত্ব তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ন্যায়বোধের প্রশ্নে। তিনি উত্তর খোঁজেন প্রাচীন গ্রিক দর্শনে।
খোদাই করেন ২২১টি পাথর, প্রতিটি একটি করে ‘ভোট’। এই ভোট সক্রেটিসের মুক্তির পক্ষে; অতএব বলা যায়, ২২১ নম্বর ভোটটি দেন বিপাশা। কারণ গ্রিক ইতিহাস অনুসারে, সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডে ২২০টি ভোট পড়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। বিপাশার কাজ যেন সেই ২২১তম ভোট। এই বোধ বস্তুত একধরনের নৈতিক প্রতিবাদ এবং মানবিক দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
বিপাশা হায়াতের ভাষায়, ‘সক্রেটিস আমার কাছে সময়ের। তাঁকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে এসে দাবি করার মানসিকতা বা চেষ্টা আমার নেই। তিনি অক্সিজেনের মতো। যাঁকে ধারণ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।’
এই শিল্পকর্ম শুধু পাথরে খোদাই নয়। এতে আরও আছে মাল্টিমিডিয়া ইনস্টলেশন, যেখানে ছিল কাগজ, কবিতা, কবিতার মতো না-হওয়া ছন্দ, আর ছিল শিল্পীর নিজস্ব অস্তিত্বের অনুসন্ধান। আমার নিজেকে খুঁজে ফেরার এই সৃজনযাত্রায় সম্পৃক্ত হয় ‘মানাস’।
ফায়জা আহমেদের বয়ানে, বিপাশা হায়াত কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি মানাসের একজন পুরোনো ক্রেতা; সেই হিসেবে এক সুদীর্ঘ সম্পর্কের একজন সম্মানিত মুখ। তিনি জানান, ‘আমি ওনার কাজ দেখেই বলেছি, এই কাজটা আমি আমার শাড়িতে চাই। তিনি অনুমতি দেন। শুরু হয় চল্লিশটি শাড়ি নিয়ে এই শিল্প অভিযাত্রার।’
মানাস বরাবরই ট্রেন্ডের দৌড়ে অংশ না নেওয়া এক ব্র্যান্ড; বরং প্রয়াস পায় শিল্পীর আত্মা, ভাবনার গভীরতা এবং শিল্পকর্মের নৈতিক সুরকে কাপড় ক্যানভাসে তুলে আনতে।
প্রতিটি শাড়ির সাদা জমিনে প্রতীয়মান দুটি করে পাথর। ২২১ থেকে মাত্র দুটি পাথরকে বেছে নেওয়া হয় নকশার মোটিফ কিংবা প্রেরণা হিসেবে। এক ইতালীয় ঐতিহাসিকের লেখার উদ্ধৃতির সঙ্গে আঁচলে বিপাশার নিজের উক্তিকে (এটি একটি কণ্ঠস্বর। মানবতার সমর্থনে দেওয়া ভোট) স্ক্রিন প্রিন্টে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়জা।
তা ছাড়া এই শাড়ির মধ্যে সোনালি কালিতে প্রতীয়মান বিপাশার স্বাক্ষর।
ফায়জা বলেন, ‘সবাই বুঝবে না, আমি জানি। তবে আমার সব কাজের মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে থাকা গল্প বলাই আমার লক্ষ্য।’
ফ্যাশন নিয়ে বিপাশা হায়াত কখনো প্রচলিত রীতির ভেতর দিয়ে হাঁটেননি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি ফ্যাশনের প্রতি সব সময়ই উদাসীন ছিলাম। তবে আমার নিজস্ব স্টাইল আছে, যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে। আমার আগের অনেক ছবি দেখে আমি ভাবি, এতটা অতিরঞ্জিত পোশাক না পরলেও হয়তো হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। হয়তো আমিও বদলেছি।’
আসলে বিপাশার কাছে তাঁর আঁকা ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর ভাবনার সঙ্গে মানানসই মাধ্যমকে তিনি বেছে নেন। বস্তুত, শিল্প হচ্ছে একধরনের ল্যান্ডস্কেপ, যা তাঁর মনোজগতের ছবিতে ক্যানভাসে প্রতীয়মান করে। তাই তো বিপাশার ভাবনায় শাড়ির পাড় হয়ে উঠতে পারে শিল্পের সীমারেখা, আঁচল হয়ে ওঠে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
তিনি মনে করেন না, চিত্রকলা ও ফ্যাশনের মধ্যে সংযোগ থাকতেই হবে; বরং যাঁরা সেটা করেন বা এই মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেন, তাঁদের জন্য তা সাধনা বৈকি!
তিনি বলেন, ‘ফায়জা আহমেদ সেটিই করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠি, গানস অ্যান্ড রোজেজের মিউজিক, চিত্রশিল্প—সবকিছুই তিনি শাড়িতে এনেছেন শিল্পের রস, সৌন্দর্য আর গুণ অক্ষুণ্ণ রেখে। এ ধরনের কাজে সাহসের প্রয়োজন হয়, গবেষণার প্রয়োজন হয়। সেটা করার সাহস দেখিয়েছেন ফায়জা। এ জন্যই তাঁর সঙ্গে এই অভিযাত্রা আমার জন্য চমৎকার এক অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতে আবারও কাজের সুযোগ পেলে আনন্দিত হব।’
শাড়ি শুধু এক টুকরো কাপড় নয়; ১২ হাত দৈর্ঘ্যের সেলাইবিহীন এই কাপড় গল্পকথকও। ফলে শাড়ি যিনি পরেন, তিনি এতে একটা পক্ষে অবস্থান নেন। ঠিক এভাবেই সক্রেটিসের ভোটের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে পারেন আপনিও।
ছবি: মানাস