বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের অ্যাওয়ে জার্সির ডিজাইনের থিম হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল নদীমাতৃক দেশ। জার্সির রং ছিল লাল। তবে সদ্য উন্মোচিত হোম জার্সির রং সাদা। আর এই জার্সির হাতে মূলত থিমভিত্তিক নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সবুজ রঙে। নেক ও হাতের রিবে সবুজের সঙ্গে আছে লালের উপস্থিতি।
হাতে যে ডিজাইন করা হয়েছে, সেটা অবশ্যই নির্দিষ্ট বিষয়কেই প্রতীয়মান করে; যেখানে আছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এ নিয়ে কথা হয় বর্তমানে কাতারে অবস্থানরত ডিজাইনার আর্নির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এবার হোম জার্সিতে দেশের অন্য ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হোম জার্সির রং সাদা হবে, এটা ছিল পূর্ব সিদ্ধান্ত। ফলে পূর্বনির্ধারিত রঙের জার্সির ডিজাইন করাটা কোনো সন্দেহ নেই চ্যালেঞ্জিং। অবশ্য সেটা আমি উতরে গেছি।’
আর্নি বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ও মার্কেটিং কমিটির সদস্য। তিনি বিশদে জানান এই জার্সির নকশায় ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে। এছাড়া স্ট্রাইড নামে তাঁর নিজের ব্র্যান্ডও আছে। তাঁর নকশা করা জার্সি বাফুফের অনুমতিক্রমে মার্কেটিং করছে দৌড়।
এখানে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জামদানির জ্যামিতিক নকশা। এর সঙ্গে আছে তিনটি জাতীয় বিষয়। জাতীয় পশু বেঙ্গল টাইগার, জাতীয় পাখি দোয়েল ও জাতীয় মাছ ইলিশ। এই চারটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে সুনিপুণভাবে। এ ক্ষেত্রে ডিজাইনারের মুনশিয়ানার তারিফ করতেই হবে। অবশ্য একজন পেশাদার গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়ায় এই নকশাবিন্যাস তাঁর পক্ষে সহজতর হয়েছে।
জামদানি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেরিটেজ টেক্সটাইল। ঐতিহ্যবাহী এই কাপড়ের নকশায় আছে অনন্যতা। বিদেশিদের কাছেও জামদানি বিশেষভাবে আদৃত। এর বয়নপদ্ধতিকে ২০১৩ সালে ইউনেসকো ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। টেকসই এই কাপড় ও এর বয়নপদ্ধতিকে জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন ডিজাইনার। এখানে তিনি জামদানির মোটিফের বিভিন্ন অংশ চমৎকার করে বিন্যাস করেছেন।
আর এই বিন্যাসের মধ্য দিয়ে আর্নি বাঘের মুখের অবয়বকে মূর্ত করেছেন। আবার সেখানেও তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য দুটি ফর্ম। যেমন বাঘের কান পেয়েছে ইলিশের আকার। আর কপালের অংশকে তিনি উড়ন্ত দোয়েলের আকার দিয়েছেন। ফলে একটা বাঘের মুখের মধ্যেই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আরও দুটি বিষয়। এসবই প্রতীয়মান হয়েছে জামদানি মোটিফের বিভিন্ন অংশের চমৎকার বিন্যাসে। এই পুরো বিষয় বা বাঘের মুখমণ্ডলের মধ্যেই কিন্তু ধরা হয়েছে আমাদের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে। কারণ, সেখানে তো সবই আছে। বাঘ যেমন আছে, আছে পাখি, মাছ ইত্যাদি।
‘বাঘ এখানে কেবল একটি নকশার উপাদানই নয়; বরং এর প্রতীকী গুরুত্বও যথেষ্ট। কারণ, সাহসীদের আমরা সাধারণত বাঘের বাচ্চা বলে অভিহিত করি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের ফুটবলারদের তুলনা করা হয়েছে বাঘের বাচ্চার সঙ্গে,’ বলছিলেন আর্নি। এ ছাড়া এখানে সাদায় সবুজের সঙ্গে লালের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় পতাকা, অর্থাৎ আমাদের জাতীয় পরিচয়কে স্পষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি।
অন্যদিকে ইংরেজি হরফে লেখা বাংলাদেশকে চমৎকারভাবে বিন্যাস করা হয়েছে, যেটা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ম্যাপ। এই নকশা অবশ্য অ্যাওয়ে জার্সিতেও ছিল। সেটা এখানেও একইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আর্নি এই থিমের নাম দিয়েছেন– বাংলার স্পন্দন। ইতালিয়ান গণিতবিদ লিওনার্দো সূত্র অনুসরণের তিনি এই নকশাকে নতুনতর মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
উল্লেখ্য, খেলাধুলার পোশাকের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। পোশাকের ডিজাইনের সঙ্গে এর ব্যবহারের উপযোগী ও আরামদায়ক উপকরণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু এর ডিজাইনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা দল এবং অবশ্যই ব্যাপকার্থে সেই দেশের ব্র্যান্ডিং। এসব বিষয়ে আমাদের ক্রীড়া–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সব সময় থেকেছেন উদাসীন। ক্রিকেট বোর্ড অবশ্য এ ক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই ডিজাইন সব সময় সব পূর্বশর্ত পালনে সক্ষম হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর মনে হচ্ছে।
ছবি: তাসমিত আফিয়াত আর্নি