
একসময়ের তেল, মরুভূমি আর বিশাল স্থাপত্যের দেশ সৌদি আরব আজ নিজেকে নতুন আলোয় আবিষ্কার করছে। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে রিয়াদ এখন বলছে অন্য গল্প—সেটা সৃজন, উদ্ভাবন আর সংস্কৃতির নবজাগরণের। সদ্য সমাপ্ত ‘রিয়াদ ফ্যাশন উইক ২০২৫’ সেই গল্পেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছয় দিনের এই উৎসব ছিল শুধু পোশাক প্রদর্শনের আয়োজন নয়, এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যেখানে ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও আত্মবিশ্বাস মিলেমিশে সৌদি ফ্যাশনের এক নতুন ভাষা তৈরি করেছে।
তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত রিয়াদ ফ্যাশন উইকের পর্দা ওঠে দ্য পাম গ্রোভে কিংবদন্তি ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল—পশ্চিমা নান্দনিকতার সঙ্গে আরব ঐতিহ্যের মেলবন্ধনই হবে এ আসরের প্রাণ। স্থানীয় সূচিশিল্পীদের হ্যান্ড এব্রয়ডারিতে ফুটে উঠেছিল হাশু, নাকদা ও জরির সূক্ষ্ম সৌন্দর্য। নিখুঁত ব্রিটিশ-কাট ও আরবের সূচিকর্মের মিশেলে তৈরি প্রতিটি পোশাক যেন ছিল একেকটি শিল্পকর্ম।

ফ্যাশন উইকের তিনটি ভেন্যু—দ্য বেডরক, দ্য রুফ-আল মামলাকা ও জ্যাক্স বিফাইভ, তিনটি সময়ের বার্তাবহ। প্রথমটি ইতিহাসের স্মারক, দ্বিতীয়টি আধুনিকতার হৃৎস্পন্দন, আর তৃতীয়টি ভবিষ্যতের নিরীক্ষাগার। এই তিন পরিসরের সংযোগই সৌদি ফ্যাশনের আত্মপরিচয়-স্বকীয়তায় দৃঢ়, কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।
এখানেই সৌদি ফ্যাশনের অনবদ্যতা। কারণ, স্বকীয়তাকে বজায় রেখে বিশ্বকে দেখিয়েছে নতুন ভাষায় কথা বলার শক্তি। একদিকে ঐতিহ্যের গরিমা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানের স্টাইল সেন্স, এই মিলনে স্পষ্ট হয়েছে সৌদি ফ্যাশনের গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা।

টিমা আবাদিয়া ও অ্যাটেলিয়ার হেকায়্যাতের মতো ডিজাইনারদের সৃজনে মিলেছে ঐতিহ্যের নতুনতর ব্যাখ্যা। ‘আ টিকিট টু দ্য থিয়েটার’ শিরোনামে অ্যাটেলিয়ার হেকায়্যাতের উপস্থাপনাকে বলাই যায় থিয়েট্রিক্যাল কবিতা। উপস্থাপনায় কেবল নাটকীয়তাই ছিল না, ছিল পোশাকও অনবদ্য। আলিয়া ও আবর ওরাইফ—দুই বোনের এই ব্র্যান্ড তাঁদের ঐতিহ্যের মমতায় আবৃত সংগ্রহের মাধ্যমে তুলে ধরেছে নারীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রেম; এই বার্তা প্রতীয়মান হয়েছে পোশাকের ভাঁজ, আলো–ছায়া আর সূক্ষ্ম অলংকরণে।
অন্যদিকে আবাদিয়া তাঁর সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে সাহস, কোমলতা ও উত্তরাধিকারের গল্প শুনিয়েছেন। ডিজাইনার শাহদ আল-শেহাইল তাঁর দাদার সমুদ্রযাত্রায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছেন যে সংগ্রহ, তা যেন আত্ম–আবিষ্কারেরই প্রয়াস। যেখানে মুক্তা আহরণের গল্প মিশেছে নারী শক্তির উপাখ্যানে। রানওয়ে–মাতানো এসব পোশাক ছিল বস্তুত সৌদি নারীর দৃঢ়তা ও স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। সদর্থেই সৌদি নারী এখন আর ছায়া নন, তিনি নিজেই আলো।
রিয়াদের আকাশচুম্বী ভবনগুলোর মতোই উচ্চাভিলাষী ছিল সদ্য শেষ হওয়া রিয়াদ ফ্যাশন উইকের পরিধি। ছয় দিনের এই আসরে ৩০ জন সৌদি ডিজাইনার তাঁদের কাপড়ে ক্যানভাসের নিপুণতা তুলে ধরেছেন।

ডিজাইনারদের মধ্যে ছিলেন টিমা আবিদ, আদনান আকবার, লিমা, ফেমিনাইন, আশওয়াক আলমারশাদ, কোরমুজ, হিন্দামে, রাজান আলাজ্জোনি, রিম আলকানহাল, ইলেভ ইলেভেন, দ্য রুফ-আল মালাকা ও এইটিনএইটিসিক্সের মতো ব্র্যান্ড ও লেবেল।
প্রত্যেকে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্থানীয় উপকরণ, জ্যামিতিক নকশা ও আরব ঐতিহ্যকে আধুনিক রূপে মেলে ধরা যায়।
হিন্দামনের ডিজাইন করা টি-শার্টে ‘সৌদি অ্যারাবিয়া ইজ দ্য ফিউচার’ কেবল স্লোগান নয়; বরং এর মধ্যে দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে পুরো প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস।
অন্যদিকে কোরমুজের বেদুইন মোটিফের ব্যাগ ডিজাইনে ঘটেছে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে দ্য রুফ-আল মালাকার র্যাম্পে দেখা গেছে নিখুঁত টেইলরিং, সংযত বর্ণবিন্যাস এবং বিশ্বমানের ফিনিশিং, যা প্রমাণ করেছে সৌদি ডিজাইন এখন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বৈশ্বিক ফ্যাশনের অংশ।
এবারের আসরের পর্দা উঠেছে ব্রিটিশ পাঙ্ক ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের সংগ্রহের উপস্থাপনায়। প্রয়াত এ ডিজাইনারের অশরীরী উপস্থিতি যেন এই আসরকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। অন্যদিকে ছয় দিনের ফ্যাশন মহোৎসবের পর্দা নামে আরেক ব্রিটিশ কিংবদন্তি স্টেলা ম্যাককার্টনির সশরীরী ও প্রোজ্জ্বল উপস্থিতিতে। এই প্রথমবারের মতো দুই ভুবনমাতানো ডিজাইনারের সংগ্রহ কেবল সৌদি আরবে নয়, এই অঞ্চলে প্রদর্শিত হলো।
রিয়াদে স্টেলার অভিষেক প্রদর্শনীটি ছিল রূপ ও বাস্তবতার এক মেলবন্ধন। মেটালিক স্লিংকি গাউন, অ্যানিমেল প্রিন্ট ট্রেঞ্চ, থাই-হাই বুট ও ত্রিশের দশকের স্লিপ ড্রেস—সব মিলিয়ে আধুনিক নারীর আত্মবিশ্বাস ও শৈল্পিক মুক্তির প্রতীক হয়েছে স্টেলার অনসম্বল।
স্টেলার এই প্রদর্শনী শুধু একটি উপস্থাপনা নয়, ছিল বার্তাও; অর্থাৎ তিনি বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সৌদি ফ্যাশন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ডিজাইনাররাও এসে তাঁদের সৃষ্টিকে উপস্থাপন করতে গর্ববোধ করেন।

এই আসরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের অংশগ্রহণ। ইতালির আমেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ইহ নম উহ নিট কিংবা কোপ্পালা এ টোপ্পোর মতো ব্র্যান্ডগুলো সৌদি বাজারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো, যেমন লিমা, ফেমনাইন বা হিন্দামনে দেখিয়েছে সৃষ্টিকর্মে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলের অনবদ্য নমুনা। স্ট্রিটওয়্যার লাইনগুলোতেও দেখা গেছে সৌদি তরুণদের আত্মবিশ্বাস—‘সৌদি অ্যারাবিয়া ইজ দি ফিউচার’ লেখা টি-শার্টের বিম্বিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের মনোভাব।
এই ফ্যাশন উইকের ছয় দিনে রিয়াদ রূপান্তরিত হয়েছিল এক চলমান আর্ট গ্যালারিতে। ওপেন-এয়ার ভেন্যু, ভবিষ্যৎধর্মী সেট ডিজাইন ও আন্তর্জাতিক অতিথিদের ভিড়—সব মিলিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এটা ছিল আরব বিশ্বের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী আয়োজন।

৪৫টি ব্র্যান্ড তাদের কালেকশন উপস্থাপন করেছে, যেখানে স্থানীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন ইউরোপ, ইতালি ও দুবাইয়ের ডিজাইনাররা। ফ্যাশন এডিটর, স্টাইলিস্ট ও রিটেইলাররা স্পষ্ট জানিয়েছেন, সৌদি ডিজাইনারদের কাজ এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম।
কোনো সন্দেহ নেই, এই ফ্যাশন উইক যেন হয়ে উঠেছিল এক তারকাখচিত উৎসব। থাই অভিনেত্রী উইন মেটাউইন, ফায়ে পেরেইরা ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গিনী জর্জিনা রদ্রিগেজের উপস্থিতিতে আলোকিত হয়েছে রিয়াদ। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকে বোঝা গেছে, সৌদি আরব এখন বিশ্ব ফ্যাশনের কেন্দ্রে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে।

সৌদি ফ্যাশন কমিশনের সিইও বুরাক চাকমাক বলেছেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যের কোনো সীমা নয়, বরং আমাদের এই যাত্রার এটা সূচনামাত্র। আমাদের ডিজাইনাররা জানেন, কীভাবে ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হয়।’
‘সৌদি ডিজাইনাররা তাঁদের নিজস্ব ভোক্তাকে বুঝে কাজ করেন, এবং সেটিই তাঁদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শিল্প এখন বৈশ্বিক, তবু গভীরভাবে স্থানীয়’, অভিমত বুরাক চাকমাকের।
চাকমাকের নেতৃত্বে সৌদি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ইতিমধ্যেই ৪২ বিলিয়ন ডলারের টার্নওভারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা দেশের জিডিপিতে ২.৫% অবদান রাখছে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে সৌদি ফ্যাশনের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।

ফ্যাশন উইকের দর্শকদের মধ্যেও ছিল নতুন উদ্দীপনা। ‘ফারফেক্ট’– এর প্রথম সৌদি স্টাইলিস্ট নৌফ আলনাম্লাহ বলছিলেন, ‘আমি প্যারিসে কোনো সৌদি ডিজাইনারের পোশাক পরলে সবাই জিজ্ঞেস করে, এটা কোথাকার? তখন গর্বে বুক ভরে যায়।’
ডিজাইনার রিম আলকানহাল, নিজেই সৌদি নারীর পোশাক সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি বলেন, ‘আজকের নারীরা ঐতিহ্য ভালোবাসে, কিন্তু আধুনিকতা থেকেও পিছিয়ে থাকতে চান না। তাঁরা রং ও স্টাইল নিয়ে নিরীক্ষা করতে জানেন। এটা কেবল ফ্যাশন নয়; বরং আত্মবিশ্বাসেরই উদ্যাপন।’
ফ্যাশন এখন সৌদি আরবের নতুন সাংস্কৃতিক ভাষা। আর সেটা প্রমাণিত রিয়াদ ফ্যাশন উইক ২০২৫-এর সফল আয়োজনে। এই আসরে কেবল রানওয়ের গ্ল্যামারই শেষ কথা ছিল না। বস্তুত সামগ্রিক আয়োজনে প্রতীয়মান হয়েছে ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ও ভুবনমাতানোর আত্মবিশ্বাস।

যেভাবে দ্য পাম গ্রোভের নিচে ঝলমলে আলো–ছায়ায় আরব সূচিকর্মে মিশেছে পশ্চিমা স্টাইল, তেমনি সৌদি ফ্যাশন এখন বিশ্বের ফ্যাশন ক্যানভাসে যোগ করেছে নতুন রং। এই রং ঐতিহ্যের, প্রত্যয়ের ও ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার। এই আসর তাই দিয়েছে এক আশাজাগানিয়া বার্তা: ‘ফ্যাশন, এখন আর কারো অনুকরণ নয়, এটা সৌদি আরবের নিজস্ব সৃজনের উদ্যাপন।’
ছবি: রিয়াদ ফ্যাশন উইকের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল