পোশাকের উপস্থাপনায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি ফায়জার
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ইসরায়েলের নির্দয় নিষ্পেষণে বিধ্বস্ত, বিস্রস্ত গাজা উপত্যকা। মৃতের জনপদে অসহায় আজ ফিলিস্তিনিরা। কাঁদছে বিচারের বাণী। সরবে। বিশ্বব্যাপী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গলা তুললেও ফলাফল শূন্য। তবু সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনার ফায়জা আহমেদ। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে পোশাক।

কাপড় ক্যানভাসে তুলে ধরা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব
কাপড় ক্যানভাসে তুলে ধরা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব

কাপড় ক্যানভাসে বিম্বিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব, আর্তি আর নিষ্ফল প্রতিরোধ। তাঁর এই হৃদয়ছোঁয়া পোশাক সংগ্রহ উপস্থাপিত হলো ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের আয়োজন দুদিনের ফ্যাশন শো খাদি: দ্য ফিউচার ফ্যাব্রিক শোয়ের প্রথম দিনে। কেবল ফিলিস্তিনিদেরই নয়, পাশাপাশি ইরাকিদের কথাও বিবৃত হয়েছে এই পোশাক সংগ্রহে। এটাই ছিল খাদির সূচনাদিনের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম উপস্থাপনা।

বিজ্ঞাপন

ফায়জার কাজ যাকে বলে একেবারেই মিনিমাল। পরিমিতির সৌন্দর্য প্রতিটি পরতে। খাদির টেকশ্চারকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জমিন সামান্যই অলংকৃত হয়েছে। সেখানেও রয়েছে বিশেষ এক ভাবনার প্রতিফলন।

প্রতিবার বোমাবর্ষণের পর গাজায় যে পরিস্থিতি হয়, সেটাই প্রতিভাত হয়েছে। বিধ্বস্ত ইমারত, ধূলিধূসরিত চারপাশ, পলেস্তারা থেকে উদ্ধার করা মানুষের শরীরে লেগে থাকা বালু–সিমেন্ট, শরীরে ক্ষতচিহ্ন—এসবকে একসঙ্গে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। আর সেই চেষ্টার প্রতিফলন ঘটাতে কাপড়কে প্রিন্ট মেশিনে প্রিন্ট করা হয়েছে। তবে আগে ডিজাইন করে নিয়ে চটের ওপর রং চড়িয়ে সেটা কাপড়ের ওপর বসিয়ে প্রিন্ট মেশিনে দিয়ে নকশাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই প্রিন্ট করা হয়েছে একাধিক রঙে। তবে কালোর প্রাধান্য ছিল। প্রতিটি প্রিন্টই আলাদা। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। এই প্রিন্ট আর হবে না বলেও জানিয়েছেন ফায়জা।

বিজ্ঞাপন

এই তাঁর প্রয়াসকে নিরীক্ষা বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমার জানামতে, ফায়জার আগে কোনো ফ্যাশন ডিজাইনার এই পদ্ধতিতে জমিন অলংকরেণ চেষ্টা করেননি। এ ছাড়া কিছু কাপড় বোনানো হয়েছে আগে সুতা রং করে নিয়ে। তুলনায় মোটা এই কাপড় দিয়ে প্যান্ট ও স্কার্ট তৈরি করা হয়েছে। এভাবেই তিনি অনবদ্য এই সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছেন।

মডেলরা হেঁটেছেন খালি পায়ে।
মডেলরা হেঁটেছেন খালি পায়ে।

স্টাইলিংয়েও কিছু বিষয় ছিল লক্ষণীয়। চুল টেনে আঁচড়িয়ে পাটের দড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেলরা হেঁটেছেন খালি পায়ে। তবে হ্রস্ব-দৈর্ঘ্যের পোশাক পরা মডেলদের পায়ে রশি দিয়ে চট বেঁধে দেওয়া ছিল। এটাও প্রতীকী বৈকি। তাঁর মতে, অনেক অপশক্তিই তো আমাদের আঁকড়ে রাখে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়, নানা স্বার্থও তো শান্তি প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়। এখানেও সেটাই বোঝানো হয়েছে।

প্রপস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে খুফিয়াহ। লাল ও কালো রঙের। এ ছাড়া কেবল একজনের হাতে ছিল পায়রা। অনেকগুলো। কাগজ দিয়ে তৈরি।

প্রপস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে খুফিয়াহ
প্রপস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে খুফিয়াহ

দুটো কিউয়ের প্রথমটায় মডেলরা হাতের তালুতে মোমবাতি নিয়ে হেঁটেছেন। দুটো কিউয়ের মাঝে চমক ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক অভিতাভ রেজা চৌধুরীর উপস্থিতি। তিনি হেঁটেছেন। তাঁর পাঞ্জাবির পিঠে লেখা ছিল ইংরেজি পিস শব্দটি। বলতেই হবে, তিনিও ফায়জার এই সাধু প্রয়াসে একাত্মতা প্রকাশ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

দুটো কিউয়ের মাঝে চমক ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর উপস্থিতি।
দুটো কিউয়ের মাঝে চমক ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর উপস্থিতি।

ফায়জার এই সংগ্রহ একেবারে নিরীক্ষাধর্মী। আর তা তিনি করেছেন কেবলই এই শোর জন্য। এটা আসলেই অসহায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশেরই নামান্তর।

ফায়জা স্পষ্টই জানিয়েছেন যে এই সংগ্রহ তিনি বিক্রির জন্য করেননি। ফলে কোনো প্রডাকশন তিনি করবেন না। এটা সহিংসতা, যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে একজন সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তাঁর সরব প্রতিবাদ।

প্রপ হিসেবে ছিল শান্তির প্রতীক পায়রা
প্রপ হিসেবে ছিল শান্তির প্রতীক পায়রা
এই সংগ্রহের পোশাক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি নয়
এই সংগ্রহের পোশাক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি নয়

এ ছাড়া তিনি মনে করেন এই সংগ্রহের পোশাক বিক্রির জন্য তৈরি করাটা একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর জন্য সমীচীন নয়। বরং একজন শিল্পীর দায়বোধ থেকেই তাঁর এই সৃষ্টিপ্রয়াস। সৃজন এখানে হয়েছে তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। পোশাকের জমিন হয়েছে ক্যানভাস। স্রোতের বিপরীতে চলা এই ডিজাইনারের অবাণিজ্যিক মনোভাব প্রতীয়মান করে তাঁর সচেতন সৃজন অভিব্যক্তিকে, স্পষ্ট করে অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর সংহতি।

ফায়জার এই সংগ্রহের নান্দনিক উপস্থাপনায় ফ্যাশন ডিরেক্টর আজরা মাহমুদের কোরিওগ্রাফির প্রশংসা করতেই হবে। তাঁর চমৎকার ও সুচিন্তিত নির্দেশনায় বাহুল্যবর্জিত, পরিমিত ছিল মডেলদের হাঁটা। এতে করে পুরো আবহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের হৃদয়।

উল্লেখ্য, এই আয়োজনের সূচনা হয় পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান বার্জার বাংলাদেশ, বিজিএমইএ ও মায়া্র শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্যে। বিইউএফটির শিক্ষার্থীরদের উপস্থাপনার পর বক্তব্য রাখেন এফডিসিবির প্রেসিডেন্ট মাহিন খান। তাঁর বক্তব্যের পরই শুরু হয় মূল আয়োজন। আর এই শো-এর প্রথমেই নিজের সৃজন উপস্থাপন করেন ফায়জা আহমেদ।

ছবি: শেখ সাইফুর রহমান

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯: ৫০
বিজ্ঞাপন