এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে উর্বশী রাউতেলার পোশাক ডিজাইন করে আলোচনায় বাংলাদেশের নবীন ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিম জোবায়ের
শেয়ার করুন
ফলো করুন

এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে বলিউডের বিউটি কুইন উর্বশী রাউতেলার পোশাক ডিজাইন করে আলোচনায় বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিম জোবায়ের।
ওত কতুরের ঝাঁ চকচকে দুনিয়ায় নিজের ছাপ রাখতে শুরু করেছে এক নতুন মুখ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিম জোবায়ের। সম্প্রতি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে নজর কেড়েছেন বলিউডের অভিনয়শিল্পী উর্বশী রাউতেলা; যিনি হলিউড হার্টথ্রব লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর কাছ থেকে পেয়েছেন ‘কুইন অব কানস’ আখ্যা। এই পোশাকের পেছনের কারিগর তাসমিম জোবায়েরের নাম এখনো অনেকেই জানেন না। তবে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের গর্ব।

তাসমিম জোবায়ের
তাসমিম জোবায়ের

তাসমিমের ব্র্যান্ডের নাম ‘টিজেড স্টুডিও’। দক্ষিণ এশীয় লাক্সারি ফ্যাশনকে পোশাকে অভিনব কায়দায় তুলে আনছেন তিনি। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার লাক্সারি ফ্যাশনের গতানুগতিক ধারায় যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। চলতি বছর প্যারিসে আটাশ অ্যাভেনিউ জঁ জরেস–এ তাসনিমের ফ্ল্যাগশিপ স্টোর আত্মপ্রকাশ করেছে।

বিজ্ঞাপন

তাসমিমের যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রামে। ডিজাইনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা খুব অল্প বয়স থেকেই। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি দার্জিলিংয়ের একটি ফ্যাশন স্কুলে ভর্তি হন। এমন সাহসী সিদ্ধান্ত তাঁর ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করে দেবে কি না, সেটা তিনি নিজেও জানতেন না।

ফটোশুটের ফাঁকে মডেলের সঙ্গে
ফটোশুটের ফাঁকে মডেলের সঙ্গে

২০১৮ সালে দুবাইয়ে প্রথম বুটিকের উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয় তাসমিম জোবায়েরের পেশাদার ডিজাইনার জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। আর্কিটেকচারাল সিলুয়েট, নারীত্বের অদম্য উদ্‌যাপন ও সূক্ষ্ম কারিগরির অদ্ভুত সুন্দর মেলবন্ধন ঘটে তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে। পরের বছর দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন উইকে তাঁর অভিষেক ঘটে। তবে তাসমিমের গল্প সত্যিকারের মোড় নেয় ২০২২ সালে, যখন তিনি প্যারিস ফ্যাশন উইকে জায়গা করে নেন এবং ২০২৩ সালে ওয়েস্টিন প্যারিস ভ্যানদোমে নিজের সম্পূর্ণ কতুর কালেকশন উপস্থাপন করেন। ফ্যাশনের এই সব শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম ভবিষ্যতের অন্যতম প্রভাবশালী ডিজাইনার হিসেবে তাঁর ভিত্তি জোরালো করে তোলে।

তাসমিম জোবায়েরের করা প্রথম ডিজাইন ছিল ক্রিস্টাল খচিত ওয়ান শোল্ডার স্যাটিনের ব্রাইডাল গাউন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, তাসনিমের ডিজাইনের লক্ষ্য কেবল ফ্যাশন ক্ষেত্রে ছাপ ফেলা নয়, বরং তিনি তাঁর কাজ দিয়ে রীতিমতো ‘আইডেন্টিটি স্টেটমেন্ট’ তৈরি করতে চান। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন এটা।

গেল ফেব্রুয়ারির প্যারিস ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপনের পর মডেলদের সঙ্গে মঞ্চে
গেল ফেব্রুয়ারির প্যারিস ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপনের পর মডেলদের সঙ্গে মঞ্চে

তাসমিমের ডিজাইনের ধরনও বেশ আলাদা। তিনি বলেন, সৃজনশীলতাকে গন্ডির মধ্যে বেঁধে দেওয়া অনুচিত। এতে সৃজনশীলতার নিজস্ব গতি নষ্ট হয়। এ জন্য তিনি প্রথম যেটা করেছেন তা হলো, সমস্যার সংজ্ঞায়ন। তিনি আরও যোগ করেন, একবার চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট হলে, সৃজনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই গতি পায়।

রানওয়েতে তাঁর পোশাকে মডেল
রানওয়েতে তাঁর পোশাকে মডেল

তাসমিম জোবায়ের বলেন, তাঁর লক্ষ্য কেবল সফল ডিজাইনার হওয়া নয়। তিনি চান বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্পের গল্পকে নতুন করে, নিজের ভাষায় বিশ্বের মানুষের কাছে বলা।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা বিশ্বের গার্মেন্টস–কারখানা হিসেবে পরিচিত। এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তাসমিম জোবায়ের। বলেন, ‘এই একটি কারণেই আমাদের দেশের সৃজনশীল সম্ভাবনা দীর্ঘদিন অবহেলিত। এ অবস্থার উন্নয়নে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।’

তাসমিমের পোশাকে
তাসমিমের পোশাকে

তাসমিম জানান, ফ্যাশনে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে একজন হতে চান না। তবে রানওয়ে, ফ্যাশন শো, রেডকার্পেট ও ফ্যাশন কথোপকথনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চান।

তাসমিমের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আত্মবিশ্বাসই তাঁকে আলাদা করে তোলে। নিজের স্বপ্নকে সুপ্ত না রেখে, বাস্তবায়নে কাজ করাটাই তাসমিমের ইচ্ছা।

এ বছর তাসমিমের করা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে উর্বশী রাউতেলার পোশাক। কান চলচ্চিত্র উৎসবে বলিউড অভিনেত্রী উর্বশী রাউতেলা তাসমিম জোবায়েরের ডিজাইন করা গাউন পরে লালগালিচায় পৌঁছালে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় বাংলাদেশের ছেলে তাসমিমের। কারণ, প্রথমবারের মতো একজন ভারতীয় অভিনেত্রী কোনো বাংলাদেশি ডিজাইনারের পোশাকে কার্লটন গালায় পা রাখেন।

এভাবেই রাওতেলার পোশাক ডিজাইন করে শিরোনামে তাসমিম
এভাবেই রাওতেলার পোশাক ডিজাইন করে শিরোনামে তাসমিম

এরপরই লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও উর্বশীকে সম্বোধন করেন ‘দ্য কুইন অব কানস’ নামে। উর্বশীর পরা অভিজাত পোশাকটি ছিল তাসমিমের ২০২৪ সালের ফল কতুর কালেকশনের। এটি মূলত একটি রুপালি ও সাদা ক্রিস্টাল এমব্রয়ডারি করা স্কাল্পটেড সুইটহার্ট নেকলাইন গাউন। তবে এর মূল আকর্ষণ হলো তিনমাত্রার ফ্লোরাল ডিজাইন। এটি পোশাকটির নান্দনিকতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও ফ্যাশনকে নতুন রূপদানের পাশাপাশি আরও একটি ইচ্ছা আছে তাসমিমের। তিনি সফল হতে চান বটে, তবে স্বপ্ন দেখেন নিজের পরিবারের। কারণ, তাঁর কাছে ফ্যাশনের মতোই জীবনও একটি সরল সমীকরণ এবং শান্তির নাম। তিনি মনে করেন, একমাত্র পরিবারই এই শান্তিতে পূর্ণতা দিতে পারে।

তাসমিমের ডিজাইন করা পোশাকে এবারের কানে নিকোল অ্যাগুইয়ের কোর্টেস
তাসমিমের ডিজাইন করা পোশাকে এবারের কানে নিকোল অ্যাগুইয়ের কোর্টেস

৮৩ হাজার ইনস্টাগ্রাম অনুসারী থাকার পরও তাসমিমের নাম অনেকের কাছে এত দিন অজানা ছিল। তাসমিম কেবল বাংলাদেশ ও প্যারিসেই নেই। পৌঁছে গেছেন সারা বিশ্বে। কারণ, তাঁর ডিজাইন সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তাঁর নকশা শুধু গ্ল্যমার নয় বরং পরিচয়, আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যতের গল্প বলে। তাসমিম জোবায়ের এখন আর কেবল একজন ডিজাইনার নন, বাংলাদেশের ফ্যাশন ইতিহাসকে নতুন যুগে রূপান্তরেরও কারিগর।

ছবি: তাসমিম জোবায়ের ও তাঁর ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১৪: ০০
বিজ্ঞাপন