কান চলচ্চিত্র উৎসব মূল ছায়াছবির আসর থেকে ফ্যাশনের আসরে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে লালগালিচায় কোন তারকা কী পরে হাঁটবেন, সেটাই হয়ে উঠেছে মুখ্য বিষয়। এ নিয়ে আগে থেকেই চলে জল্পনা। আর আসর চলাকালে সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারকাদের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় তাঁদের পোশাক ডিজাইনারের নামও। এই বৈশ্বিক আসরে আমাদের তারকারাও উপস্থিত হন দেশীয় ডিজাইনারদের পোশাক পরে। একই দৃশ্য দেখা যায় ভারতীয় ক্ষেত্রেও। কিন্তু কোনো বাংলাদেশি ডিজাইনারের পোশাকে বিদেশিরা কানের লালগালিচায় হাঁটছেন, এতটা আমরা ভাবতেও পারি না। অথচ সেটাই ঘটেছে এবার। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অন্তত আধডজন তারকা এবার কানে পরেছেন জুরহেমের পোশাক।
আপনাদের স্মরণে থাকতে পারে, হাউস অব ভেন্ডোমের আমন্ত্রণে গেল মার্চে প্যারিস ফ্যাশন উইক চলাকালে প্যারিসে নতুন কালেকশন উপস্থাপন করেছিলেন দেশের হাইফ্যাশন ব্র্যান্ড জুরহেমের ডিজাইনার মেহরুজ মুনির। তাঁর সেই সোলারিস কালেকশনে বেশ কিছু পোশাক সেই সময়েই বিক্রি হয়ে যায়। আর বাকি পোশাক তিনি দেশে ফিরিয়ে আনেননি। বরং সেখানকার একটি নামকরা জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের কাছে রেখে এসেছিলেন। তারাই মূলত এসব পোশাক তারকাদের দিয়েছে কানে পরার জন্য, কথা প্রসঙ্গে জানালেন মেহরুজ।
এ ক্ষেত্রে বলতেই হবে, এটা জুরহেমের জয়জয়কারও। আবার বাংলাদেশের ফ্যাশনেরও এটা সন্দেহাতীত, বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্যও এক দারুণ খবর।
জুরহেমের ওই ফল–উইন্টার ২০২৫ সংগ্রহের নাম ছিল সোলারিস। এই সংগ্রহ ছিল সূর্যের রংবদলের প্রেরণায় তৈরি। এই সংগ্রহের প্রকাশ পেয়েছে অপার্থিব সৌন্দর্যের সঙ্গে জ্যামিতিক নকশার প্রতি মেহরুজের অনুরাগ। তিনি এই সংগ্রহের পোশাকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন আশাবাদ এবং দীপ্তিময় শক্তির মেলবন্ধন। কারণ, সোলারিজ বস্তুত আঁধার থেকে আলোয় ফেরার উদ্যাপন।
সাহসী নকশা ও নিখুঁত নকশাশৈলীর জন্য পরিচিত এই জুরহেম প্যারিসে শোর মাধ্যমে কেবল আন্তর্জাতিক অভিষেকই হয়নি, বরং ওই শোর কারণেই তাঁর নামও ছড়িয়েছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক তারকাদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। জুরহেমের পোশাক তাদের এতটাই মনে ধরেছে যে এবার কানে তাঁরা পরেছেন এবং হেঁটেছেন লালগালিচায়। এটা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ফরাসি অভিনেতা ও মডেল সুফিয়ান সাই উৎসবের শুরুতেই পরেন জুরহেমের সোলারিস সংগ্রহের সোনালি কর্ডুরয়ের স্যুট। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে চমৎকার প্রাণোচ্ছল অভিব্যক্তি।
ফরাসি উদ্যোক্তা ভায়া ব্রাজিয়ার পরেছিলেন নাটকীয় সানবার্স্ট ও কাটআউটের সাদা গাউন।
মিস ফ্রান্স ২০১৯ ওফেলি মেজিনো উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তা বসানো ট্রেঞ্চ কোটে। এটা বস্তুত লিঙ্গ ও সৌন্দর্যের বাঁধাধরা ধারণা ভাঙা এক পোশাক।
এমব্রয়ডারড ব্রালেট ও কালো কাটআউট স্কার্টে অনবদ্য ছিলেন মিডিয়া উদ্যোক্তা পলা রিটা সাদি।
উদ্যোক্তা ও ফুটবলার কার্ট জুমার স্ত্রী স্যান্ড্রা জুমা পরেছিলেন সূর্যের প্রতিচ্ছবিযুক্ত সবুজ ভেলভেট টপ।
জুরহেমের বিশেষ পোশাকে আরও নজর কাড়েন ওয়ারেন সিএস ও ইয়েনি।
এখানেই শেষ নয়। বরং জুরহেমের পোশাক আরও পরছেন বাংলাদেশি ইন্টারনেট সেনসেশন আল আমিন। আলী নামে আদনান আল রাজীব পরিচালিত শর্টফিল্মের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। আর তাঁর পোশাক ডিজাইন করেছেন মেহরুজ মুনির। বললেন, এই পোশাকের প্রেরণা ছিল শাপলা। কারণ, এটা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনন্য পরিচয়।
প্যারিসের রানওয়েতে শুরু হয়েছিল জুরহেমের বৈশ্বিক অভিযাত্রা। এবার সেই পথ গিয়ে মিশেছে কানে। লালগালিচায় তারকা স্বচ্ছন্দে পরেছেন জুরহেমের পোশাক। এটা জুরহেম তো বটেই, বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
এর মধ্য দিয়ে কেবল ফ্যাশনের নয়, বরং বাংলাদেশের সৃজনশীলতাকে বিশ্বের ফ্যাশনিস্তাদের নজরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে নিজেরাই কেবল এগিয়ে থাকল তা নয়, বরং অন্যদের এগিয়ে যাওয়ার পথও দেখাতে পারল জুরহেম। এর মধ্য দিয়ে অবশ্যই প্রমাণিত হলো বাংলাদেশেও জন্ম নিতে পারে বিশ্বমানের বিলাসবহুল ব্র্যান্ড। উপরন্তু জুরহেমের এই সাফল্য কোনো ব্র্যান্ডের অর্জন নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। বাংলা সংস্কৃতি ও নকশা কেবল আন্তর্জাতিক ফ্যাশন পরিমণ্ডলে সমাদৃত হচ্ছে না, বরং নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন আলোচনায়।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল