পশ্চিম লন্ডনের ওল্ড বন্ড স্ট্রিট। একদিকে পিকাডেলি সার্কাস আর অন্যদিকে অক্সফোর্ড স্ট্রিট। এরই মাঝে সপ্তদশ শতকে তৈরি এই জনপথ অভিজাতদের চারণক্ষেত্র। এই রাস্তার ২৭ নম্বর বাড়িটির রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্য। এখানেই অবস্থিত স্বনামের ব্র্যান্ড আলেকজান্ডার ম্যাককুইন। বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইনার আলেকজান্ডার ম্যাককুইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নামে। ১৯৯২ সালে। সাফল্য পেতে সময় লাগেনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি জিভাঁসির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও নিজের এই এক টুকরা পৃথিবীটার কোনো হেরফের করেননি। সেটা অবশ্য এখনো অবিকল থাকলেও নেই তিনি আর। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা যান। চরম হতাশায় আক্রান্ত ছিলেন এই অসামান্য ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর মৃত্যুর পর হাল ধরেন তাঁর সহকারী সারাহ বার্টন।
বহুল পরিচিত এবং থিমেটিক ডিজাইনার শপ আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের প্রতিটি উপস্থাপনাই মনোমুগ্ধকর। এখানে সাজানো রয়েছে ওত কতুরের সংগ্রহ। প্রতিটি গাউনের ডিজাইনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েরই বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে। সেই সঙ্গে পোশাকের পরিকল্পনা এবং লে–আউটেও বিস্তারিত ছবির মাধ্যমে সাজানো আছে।
ম্যাককুইনের মৃত্যুর পর সারা বার্টন এই ব্র্যান্ডের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। ব্রিটেনে প্রথম সারির একজন ডিজাইনার সারাহ। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়েছে ব্রিটেনের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নাতবউ ক্যাথরিন মিডলটনের বিয়ের পোশাক ডিজাইন করে।
এই স্টোরের ওপরের তলায় ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এই প্রদর্শনীকে বস্তুত বলা যায় অগ্রজের প্রতি অনুজের নিবেদন। কারণ, প্রয়াত ফ্যাশন ডিজাইনার আলেকজান্ডার ম্যাককুইন ২০০৭ সালের স্প্রিং-সামার কালেকশন সারাবান্দেতে যে পোশাক ডিজাইন করেছিলেন, তারই প্রেরণায় সারাহ ২০১৯ সালের অটাম-উইন্টার কালেকশন করেন। ম্যাককুইনের থিম ছিল গোলাপ আর হাইড্রাঞ্জা। আর সারাহ সেখানে বেছে নেন কেবলই গোলাপ। ম্যাককুইন চারটি রং নিয়ে তাঁর সৃজনক্ষেত্র সাজিয়েছিলেন। সারাহ কেবল লাল গোলাপেই স্থিত থেকেছেন। এই প্রদর্শনীতে ম্যাককুইনের সেই ২০০৭ সালের পোশাক যেমন আছে, তেমনি আছে সারাহ ২০১৯ সালের পোশাকও।
২০০৭ সালের স্প্রিং-সামার কালেকশনে হাইড্রানজিয়া ও গোলাপ ছিল আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের প্রেরণা। চারটি ফুলের রং নিয়ে এই কালেকশন তৈরি করা হয়। এই কালেকশনের লে-আউট স্কেচ ড্রয়িংয়ের প্রতিটি ধাপ এবং সব ম্যাটেরিয়ালস, ফেব্রিক সোয়াচ, অ্যাকসেসরিজ, ট্রিমিংস, এমব্রয়ডারি টেকনিক সোয়াচ সবকিছু সাজানো ছিল প্রর্শনীতে।
সারাবান্দে শো ছিল আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের একটি বিশেষ উপস্থাপনা। এই কালেকশন দারুণ সাড়া ফেলে পুরো ফ্যাশন দুনিয়ায়। কারণ, জীবন্ত গোলাপ ও হাইড্রানজিয়া—এই দুই ধরনের ফুল আর ফুলের চারটি রং—লিলিয়াক, গাঢ় লাল, বারগেন্ডি ও পার্পলই ছিল মূল কালেকশনে। এই চার রঙের ফুল ছিল কুঁড়ি অবস্থায়। এই শোর সবচেয়ে মুগ্ধকর বিষয় ছিল লাইভ অর্কেস্ট্রা। সেদিনের সেই ফ্যাশন শোতে বাজানো হয়েছিল হ্যান্ডলের ‘সারাবান্দ পিস’। স্ট্যানলি কুবরিকের ১৯৭৫ সালে ছায়াছবি ‘ব্যারি লিন্ডন’ থেকেই নেওয়া হয়েছিল টুকরাটি। বৃত্তাকার ঝাড়বাতির চারপাশে ঘিরে তৈরি র্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা। আর যাওয়ার সময় জীবন্ত ফুলগুলোর কিছু কিছু পড়েছে পোশাকের পেছন থেকে। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর শো ছিল, যা ওই শোতে উপস্থিত ফ্যাশনপ্রিয়দের মনে এখনো দাগ কেটে আছে। সেই কালেকশনটাকেই পুনরায় উপস্থাপন করেছেন সারা বার্টন। সবাইকে আরও একবার দেখার সুযোগ করে দিতেই তাঁর এই প্রদর্শনীর উদ্যোগ। যেটা শুরু হয়েছে গত বছর।
২০১৯ সালে সারা বার্টন যে অটাম-উইন্টার সংগ্রহ তৈরি করেন, তা বলা যেতে পারে ম্যাককুইনের ওই সৃজনশীলতাকেই নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস। তবে এই উপস্থাপনায় সারাহ মূল কনসেপ্টে কিছুটা পরিবর্তন এনে হাইড্রানজিয়ার বদলে গোলাপকেই প্রাধান্য দেন। নতুন আঙ্গিকে তৈরি প্রতিটি ড্রেস এক্সক্লুসিভলি ডিজাইন করা হয়েছে। কাপড় থেকে অনুষঙ্গসহ ট্রিমিংসও প্রতিটি পোশাকের জন্য আলাদা করে ডিজাইন করা। রোজ কালেকশনের সিলুয়েটের প্যাটার্নকে অনেক বৈচিত্র্যময় করা হয়েছে এবং প্রতিটি ড্রেসের লুকেই স্পষ্ট গোলাপের থিম। নানা ধরনের সিল্ক, মসলিন এবং বারল্যাপ দিয়েই তৈরি হয়েছে পুরো সংগ্রহ। পাশাপাশি এই সংগ্রহের প্রতিটি পোশাকে টেকসই ফ্যাশন পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
এই কালেকশনের কনসেপ্ট সম্পর্কে সারাহর অভিমত, গোলাপ হচ্ছে ফুলের রানি। বিশেষ করে ব্রিটিশ ফুলের মধ্যে। গোলাপ নারীত্বকে প্রকাশ করে। গোলাপের কুঁড়ির সৌন্দর্য থেকে প্রস্ফুটিত হওয়ার বিষয়টা মানুষের জীবনচক্রকেই মনে করিয়ে দেয়। যেখানে মানুষের জীবনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সময়কাল আলাদা সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে পূর্ণ থাকে।
প্রদর্শনীতে প্রবেশের মুখেই ছিল আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের একটি উদ্ধৃতি: আমি যেটাই করি না কেন, সেটা কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
প্রদর্শনীতে অগ্রজ-অনুজ উভয়ে দুই আইকনিক পোশাকই পাশাপাশি উপস্থাপিত হয়। বিশেষ করে ম্যাককুইনের সেই তাজা ফুলের পোশাকের ফ্লোরাল ফিনালের পাশে রাখা হয় সারাহর শোস্টপিং লাল ড্রেসটি। এই প্রদর্শনীর নামও দেওয়া হয় ‘রোজেস’। এই প্রদর্শনীর দেখার মতো বিষয় হলো দুই প্রজন্মের দুই সৃষ্টিশীলের সৃজনভাবনা, কৌশলগত নিপুণতা, প্রকৃতি-ভাবনা ও সর্বোপরি তাঁদের সৃজনশীলতা। তবে এই প্রদর্শনীর কেন্দ্রে ছিল উভয়ের প্রেরণায় ফুল। এবং সৃজনপ্রেরণা সেই ফুলের শক্তি, সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য। ম্যাককুইনের সেই পোশাককে পুষ্পকাব্য বললে সারাহর ড্রেসটিকে পুষ্প প্রণোদনা বলাই যায়।
জমে যাওয়া প্রচুর পুরোনো কাপড় নিয়ে কাজ শুরু করেছেন সারাহ বার্টন। এসবই নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করেন তিনি।
সারাহ তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে চান এবং তাঁদের সঙ্গে সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছেন। যাতে করে নতুন প্রজন্ম এটাকে লালন করে এবং আরও ফ্যাশনেবলভাবে উপস্থাপন করতে পারে। কারণ, তিনি মনে করেন যে ভবিষ্যৎ তাঁদেরই হাতে। ক্রিয়েটিভ আইডিয়ার জন্য চিন্তায় স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন বলেও তাঁর অভিমত। তাই তো সৃজনশীল কাজে প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তাধারাকে সামনে
উপস্থাপন করাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এই সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব।
‘ডিজাইনে কোনো কিছুই ভুল না’—এটাই ছিল প্রয়াত ফ্যাশন ডিজাইনার
আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের মূলমন্ত্র। অভিন্ন ভাবনায় বিশ্বাস সারা বার্টনেরও।